ফিলিস্তিনকে কেন স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে ব্রিটেন?

ফানাম নিউজ
  ৩০ জুলাই ২০২৫, ২০:০৪

অবরুদ্ধ গাজা গাজা উপত্যকার দুর্দশা লাঘবে ইসরায়েল যদি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে আগামী সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ফিলিস্তিনকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেবে যুক্তরাজ্য। 

মঙ্গলবার ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতির বিষয়ে এই ঘোষণা দিয়েছেন।

• কী বলেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার?

তিনি বলেছেন, ইসরায়েল নির্দিষ্ট কিছু শর্ত পূরণ না করলে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেবে ব্রিটেন।

• কী কী শর্ত?
• গাজায় ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাসের মাঝে যুদ্ধবিরতি
• গাজা উপত্যকায় আরও বেশি ত্রাণ প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি

• ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরকে নতুন করে দখল কিংবা সংযুক্ত না করার স্পষ্ট ঘোষণা

• দীর্ঘমেয়াীং শান্তি প্রক্রিয়ায় অঙ্গীকার। যার মাধ্যমে দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের বাস্তবায়ন হবে। অর্থাৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ও ইসরায়েলের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।

স্টারমার বলেন, ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে কোনও নীতিগত সমতা নেই। হামাসের কাছে আমাদের দাবি আগের মতোই আছে। তাদের ইসরায়েলি সব জিম্মির মুক্তি, যুদ্ধবিরতিতে রাজি, গাজা শাসনে আর অংশ না নেওয়া এবং নিজেদের অস্ত্র ত্যাগ করতে হবে।

• কেন এই সিদ্ধান্ত নিলেন স্টারমার?

ব্রিটেনের অতীতের বিভিন্ন সরকারও দীর্ঘদিন ধরে বলেছে, ‌কেবল সঠিক সময় ও প্রেক্ষাপটেই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। যাতে দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানকে এগিয়ে নেওয়া যায়।

ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতির পরিবর্তে গাজায় ক্ষতিগ্রস্ত বেসামরিক নাগরিকদের অবস্থার উন্নয়নই ব্রিটেনের অগ্রাধিকার বলে দেশটির সরকার জানিয়েছিল। কিন্তু গাজায় দুর্ভিক্ষ ও ইসরায়েলি ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে স্টারমার দিন দিন সরব হয়ে উঠছেন। পাশাপাশি নিজ দল লেবার পার্টির আইনপ্রণেতাদের দিক থেকেও তার ওপর চাপ বাড়ছিল।

এই উদ্যোগের ফলে ইসরায়েলের আচরণে বাস্তব প্রভাব পড়বে বলে প্রত্যাশা করছে ব্রিটেন। দেশটি বলেছে, ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতির ঘোষণায় গাজায় অন্তত ত্রাণ সরবরাহ বাড়বে এবং দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক শান্তি আলোচনায় গতি আসবে।

• এর বাস্তব ফল কী হতে পারে?

ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জুলি নরম্যান বলেছেন, ব্রিটেনের এই উদ্যোগ প্রতীকী হলেও কূটনৈতিক ও নৈতিকভাবে এর প্রভাব অনেক। আর ব্রিটেনের ক্ষমতাসীন সরকারের এক কর্মকর্তার মতে, সবচেয়ে তাৎক্ষণিক পরিবর্তন হতে পারে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নীত করা। বর্তমানে ব্রিটেনে ফিলিস্তিনের একটি মিশন রয়েছে। তবে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিলে সেটি পূর্ণাঙ্গ দূতাবাসে রূপ নিতে পারে।

তিনি বলেন, ভবিষ্যতে ব্রিটেন পশ্চিম তীরে একটি দূতাবাস স্থাপন করতে পারে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ভবিষ্যতের ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জন্য পশ্চিম তীর, গাজা ও পূর্ব জেরুজালেমকে নিজেদের ভূখণ্ড বলে দাবি করে। বর্তমানে ইসরায়েলি সামরিক দখলদারিত্বের আওতায় থাকা পশ্চিম তীরে পশ্চিমা বিশ্ব-সমর্থিত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ সীমিতভাবে শাসন কাজ পরিচালনা করছে।

হামাস ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে। ১৯৮৮ সালে এই গোষ্ঠীটির প্রতিষ্ঠাকালীন ঘোষণায় ইসরায়েল ধ্বংসের ডাক দেওয়া হয়েছিল।

জেরুজালেমে নিযুক্ত ব্রিটেনের সাবেক কনসাল জেনারেল ভিনসেন্ট ফিন বলেন, ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া হলে ইসরায়েলের সঙ্গে ব্রিটেনের সম্পর্ক নতুন করে পর্যালোচনার দরকার হতে পারে। এর ফলে ইসরায়েল অধিকৃত অঞ্চলের বসতি থেকে আমদানি করা পণ্যে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে ব্রিটেন।

তিনি বলেন, যদিও ওই পণ্যের পরিমাণ একেবারে সামান্য। তারপরও ব্রিটেন যদি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তাহলে সেটি ইসরায়েলের অর্থনীতিতে প্রতীকী প্রভাব ফেলবে।

তবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতির ফলে ব্রিটেন-ইসরায়েলের দ্বিপাক্ষিক গোয়েন্দা সহযোগিতা ও প্রতিরক্ষা-সংক্রান্ত সরবরাহ ব্যবস্থা কতটা প্রভাবিত হবে, তা এখনও নিশ্চিত নয়। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের ঘোষণায় ইসরায়েলে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ব্রিটেনের এই সিদ্ধান্ত হামাসকে পুরস্কৃত করার শামিল। এর মাধ্যমে ২০২৩ সালে হামাসের সীমান্ত হামলার শিকারদের প্রতি অবিচার করা হবে।

ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্রিটিশ সিদ্ধান্ত নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়েছে। এই বিষয়ে বুধবার এলবিসি রেডিওকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ব্রিটেনের পরিবহনমন্ত্রী হেইডি আলেকজান্ডার বলেছেন, এটি ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‌‌‘‘এটি হামাসকে পুরস্কৃত করার ব্যাপার নয়। হামাস জঘন্য সন্ত্রাসী সংগঠন। এই স্বীকৃতি ফিলিস্তিনি জনগণের, বিশেষ করে গাজার শিশুদের জন্য—যারা অভুক্ত অবস্থায় মৃত্যুর মুখে পড়ছে।''

• যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে কেমন?

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্টারমার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। গত সোমবার স্কটল্যান্ডে সাক্ষাৎও করেছেন এই দুই নেতা। যদিও ওই সাক্ষাতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি নিয়ে তাদের মাঝে কোনও আলোচনা হয়নি।

ট্রাম্প প্রাথমিকভাবে ফিলিস্তিনকে ব্রিটেনের স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিষয়ে কোনও কিছু মনে করছেন না বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে ফেরার পথে মঙ্গলবার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেছেন, ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া হলে তা হামাসকে পুরস্কৃত করার শামিল হবে।

• ফিলিস্তিনকে আর কারা স্বীকৃতি দিয়েছে?

স্টারমারের ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে ফ্রান্স। দেশটির প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ কয়েক দিন আগেই তার দেশের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন।

এর আগে, ২০২৩ সালে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে ও স্পেন। তবে এই স্বীকৃতিতে ইসরায়েলের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অধিকারে কোনও আঘাত করবে না বলেও পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয় তারা।

জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্য দেশের মধ্যে প্রায় ১৪৪টিই ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এসব দেশের তালিকার বেশিরভাগই গ্লোবাল সাউথ ভুক্ত। এর পাশাপাশি আছে রাশিয়া, চীন ও ভারতও।

তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ২৭ সদস্যের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি দেশসহ সুইডেন, সাইপ্রাস ও পূর্ব ইউরোপের সাবেক সমাজতান্ত্রিক কয়েকটি রাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

২০১২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে একটি প্রস্তাব পাস হয়। এই প্রস্তাবে সংস্থাটিতে ফিলিস্তিনকে পর্যবেক্ষক থেকে ‌‘অ-সদস্য রাষ্ট্রের’ মর্যাদা দেওয়া হয়।

• এরপর স্বীকৃতি দিতে পারে কারা?

স্টারমারের সিদ্ধান্ত জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও জাপানের মতো বড় দেশগুলোর ওপর ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে চাপ বৃদ্ধি করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

গত শুক্রবার জার্মানি বলেছে, তারা শিগগিরই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরিকল্পনা করছে না। অন্যদিকে ইতালি বলেছে, ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলকে একযোগে স্বীকৃতি দেওয়ার পথেই এগোতে চায় রোম।

সূত্র: রয়টার্স।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়