গ্রামের এক মসজিদে মাত্র ২৪- ২৫ বছর বয়সে এসে ইমামতি ও গ্রামের মক্তবে পড়িয়ে ৮০ বছর বয়সে অবসর নিলেন হাফেজ মাওলানা আবু মুছা। তার বিদায়কে জাঁকজমকপূর্ণ করে অবিস্মরণীয় করে রাখলেন পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার যশমন্তদুলিয়া গ্রামের লোকজন। সম্প্রতি তার বিদায়ের প্রাক্কালে গ্রামবাসী তাকে রাজকীয় বিদায় সংবর্ধনার অয়োজন করেন। তার হাতে তুলে দেওয়া হয় এক লাখ টাকা ও নানা উপহার সামগ্রী। হাফেজ মাওলানা আবু মুছা পাবনার সুজানগর উপজেলার তাঁতীবন্ধ ইউনিয়নের বাড়ইপাড়া গ্রামের মৃত শাহাব উদ্দিনের ছেলে।
যশমন্তদুলিয়া গ্রামের স্কুল শিক্ষক রেজাউল করিম জানান, হাফেজ মাওলানা আবু মুছা হেফজ সম্পন্ন করে যশমন্তদুলিয়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে ইমামতি ও মক্তবে পড়ানোর চাকরি নেন। চাকরি করছেন, তবে তিনি কোনোদিন বেতন ভাতার জন্য দর কষাকষি করেননি। গ্রামবাসী তাকে যা খুশি দিয়েছেন, তিনি তা না গুনেই নিয়ে নিয়েছেন।
রেজাউল করিম আরো জানান, তিনি তারও ওস্তাদ। তার মতো হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে এ ইমাম সাহেবের কাছে পড়েছেন।
গ্রামের আরেক স্কুল শিক্ষক আকরাম হোসেন জানান, একজন সাদা মনের মানুষ ইমাম আবু মুছা। একই কর্মস্থলে এতটি বছর তিনি চাকরি করছেন অথচ কারো সঙ্গে তার দুটি কথা হয়নি। এজন্য চাকরি বদল করারও দরকার হয়নি। তিনি বয়সের ভারে চাকরি ছাড়তে চাইলেও গ্রামবাসী তাকে এতদিন ছাড়েননি।
গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইমাম সাহেব বার্ধক্যজনিত কারণে চাকরি থেকে অবসরে গেছেন। গ্রামবাসী তাকে না জানিয়েই বিশাল আয়োজনের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। তারা চেয়েছিলেন এমন একজন মহৎ ব্যক্তির বিদায় অনুষ্ঠান যেন স্মরণীয় হয়ে থাকে। তাই তারা সুসজ্জিত মঞ্চ করে বিদায় অনুষ্ঠানের অয়োজন করেন। সেখানে নানা বয়সি মানুষ স্মৃতিচারণ করেন। গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে ইমাম সাহেবকে এক লাখ টাকা উপহার দেওয়া হয়। তাকে আরো নানা উপহার সামগ্রী দেওয়া হয়েছে। বিদায় সংবর্ধনা শেষে তাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থাও করা হয়। এ ক্ষেত্রে গ্রামের যুব সমাজ মোটরসাইকেল বহরে করে তাকে সুসজ্জিত ঘোড়ার গাড়িতে করে তার নিজ বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসেন।
এমন রাজকীয় বিদায় সংবর্ধনায় অভিভূত হাফেজ মাওলানা আবু মুছা। তিনি জানান, অনেক কম বয়সে ওই গ্রামে চাকরিতে যান। তখনও দেশ স্বাধীন হয়নি। তাকে যারা চাকরিতে নিয়েছিলেন সেসব মুরুব্বিরা আজ আর বেঁচে নেই। তবে তাদের সন্তানরা, গ্রামের অন্যান্যরা তাকে ভালোবাসেন, শ্রদ্ধা করেন।
তিনি জানান, তিনি যখন মক্তবে পড়াতেন তখন আশপাশের গ্রামে এত মসজিদ-মক্তব, মাদরাসা ছিল না। তাই পার্শ্ববর্তী দহেরপড়া, ক্রোপদুলিয়া, ঘোড়াদহ, ভবানীপুর, জিয়লগাড়ী প্রভৃতি গ্রামের ছেলে মেয়েরা তার মক্তবে পড়তে আসত। তাই তার ছাত্র-ছাত্রী কয়েক গ্রাম জুড়ে রয়েছে। তিনি অসংখ্য ছাত্রীদের কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন। তাদের অনেকেই আজ বড় বড় চাকরি পেয়েছেন। কিন্তু তারা তাকে ভুলে যাননি। তাকে ভালোবাসেন। তিনি জানান, এ গ্রামের অন্যান্য মসজিদ, ঈদগাহ, কবরস্থান তাকে সঙ্গে করে নিয়েই এলাকাবাসী প্রতিষ্ঠা করেছেন।
তিনি জানান, তার বয়স হয়ে যাওয়ায় নানা রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছেন। তাই তার পক্ষে আর দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হয়নি। তিনি গ্রামবাসীর অনুরোধ সত্ত্বেও চাকরি ছেড়ে এসেছেন । তিনি অসংখ্য ছাত্রীদের পবিত্র কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন। তারা আজ গৃহিণী বা বৃদ্ধার পর্যায়ে চলে গেছেন। বিদায়ের প্রাক্কালে তারাও তার জন্য কষ্ট পেয়েছেন, দোয়া করেছেন। সবার ভালোঅবাসাই তার জীবনের বড় পাওয়া।
তিনি আরো জানান, ব্যক্তি জীবনে তিনি ৩ ছেলে ৫ মেয়ের বাবা। তিনি তাদেরকে মাদরাসা শিক্ষা দিয়েছেন। পরে তারা উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। দু’ ছেলে চাকরি করছে এক ছেলে পড়াশোনা । মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন।
যশমন্তদুলিয়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ কমিটির সভাপতি মইনউদ্দিন আহমেদ বলেন, মসজিদের ইমাম আবু মুছা দীর্ঘ ৫৩ বছর তাদের মসজিদে ইমাম ও খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বার্ধক্যজনিতকারণে বিদায় নিয়েছেন। গ্রামবাসী তাকে ছাড়তে চাননি। তিনি তাদের গ্রামেরই একজন, পরম আপনজন হয়ে ছিলেন। তিনি ছিলেন তাদের অভিভাবকের মতো। তার বিদায় বেলায় তারা ব্যথিত হয়েছেন। তাকে তারা সম্মানিত করার চেষ্টা করেছেন।
পাবনা চাঁপা বিবি মসজিদের খতিব আলহাজ্ব সাওলান সিবগাতুল্লাহ জানান, একজন ইমাম সমাজের নেতা। তারা এমন সম্মান ও রাজকীয় বিদায় সংবর্ধনা দিয়ে খুবই প্রশংসনীয় কাজ করেছেন এলাকাবাসী।