গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে করোনার প্যানডেমিক চলছে তার আপন গতিতে, তাণ্ডবলীলা চালিয়ে যাচ্ছে সারা বিশ্বে। যেহেতু করোনা সম্পূর্ণ একটি নতুন রোগ, তাই শুরুতে এর চিকিৎসক এবং প্রতিরোধব্যবস্থা নিয়ে বিজ্ঞানী ও চিকিৎসক এবং জনগণের মাঝে ভয়ভীতি ছিল এবং সেটা থাকাটাই স্বাভাবিক। এমনকি ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীও কিন্তু আতঙ্কগ্রস্ত ছিলেন। কারণ এর উত্পত্তি, জটিলতা, পরীক্ষানিরীক্ষা এবং চিকিত্সা কোনো কিছুই কারো জানা ছিল না। শুরুতে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বিরুদ্ধে রোগী এবং তার স্বজনদের অভিযোগ ছিল অনেক। যেমন—ডাক্তাররা রোগীর কাছে যায় না, গায়ে হাত দেয় না, রোগের কথা শোনে না, ভালোভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা করে না, টেলিফোনে চিকিৎসক দেয় ইত্যাদি। নার্সরা রোগীর সেবা পরিচর্যা ঠিকভাবে করে না, ওষুধ খাওয়ায় না, এমনকি অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা রোগীর খাবারদাবার ঠিকমতো দেয় না। তবে বর্তমানের পরিস্থিতি অনেক উন্নত। ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রথম সারির যোদ্ধা, তারা সব ভয় জয় করে জীবনবাজি রেখেই আক্রান্তদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে, করোনাকালের পুরোটা সময় অভাবনীয় সেবা দিয়েছেন এবং দিয়ে চলছেন।
শুরুতেই অনেক সমস্যার মধ্যে ওষুধপত্র ও চিকিৎসাসামগ্রীর অভাব এবং পরীক্ষানিরীক্ষার সীমাবদ্ধতা ছিল। তবে সীমিত সামর্থ্য এবং সুরক্ষাব্যবস্থা নিয়ে চিকিৎসকরা নেমে পড়েন করোনা মোকাবিলায়। এমনকি লকডাউন ঘোষণার পর সারা দেশের মানুষ যখন ঘরবন্দি, তখন বিরামহীনভাবে করোনা আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে চিকিৎসকরা জানিয়ে দেন, তারা প্রস্তুত এ মহামারি মোকাবিলায়।
করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি বেশ কিছু হাসপাতালকে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল ঘোষণাসহ সব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জেলা সদর হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে কোভিড ইউনিট খোলা হয়। এছাড়া বেশ কিছু ফিল্ড হাসপাতালও প্রস্তুত করা হয় এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
করোনার প্রকোপ বেড়ে গেলে এর চাপ পড়ে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর। এসব উপেক্ষা করেই কোভিড হাসপাতালে যেসব চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা চিকিৎসাকাজে নিয়োজিত আছেন, তারা কিন্তু জীবন বাজি রেখেই চিকিত্সাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত কোনো চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা ভয়ে চিকিৎসাসেবা দিতে বিরত থাকেননি। এসব হাসপাতালে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এবং সুচারুরূপে করোনার চিকিৎসা দিয়ে আসছেন চিকিৎসকরা। এর প্রমাণ মেলে করোনায় মৃত্যুর হার পর্যালোচনা করলে। সারা বিশ্বে কোভিডে মৃত্যুর হার যেখানে প্রায় ২.০৭ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশে মৃত্যুর হার ১.৫৮ শতাংশ। অনেক উন্নত দেশের মৃত্যুর সংখ্যা যেখানে লাখ লাখ, সেখানে আমাদের দেশের মৃত্যু এখনো কয়েক হাজারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। তবে এতে আত্মতৃপ্তির কোনো সুযোগ নেই। যারা মারা গেছেন বা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন তাদের জন্য আমরা সত্যিই মর্মাহত, তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
সাধারণ মানুষ যখন করোনার ভয়ে ভীত, কোনো হাসপাতালের আশপাশ দিয়ে গমনও করে না, নিরুপায় ও নিতান্তই অসহায় হয়ে যখন ঘরবন্দি জীবন কাটাচ্ছেন, তখন চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরাই কিন্তু পরিবার-পরিজন ফেলে হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগীর সার্বক্ষণিক চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। রোগীর সঙ্গে কথা বলছেন, আশার বাণী শোনাচ্ছেন, সরাসরি স্পর্শ করছেন, রোগীর গায়ে হাত দিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করছেন। নার্সরা ইনজেকশন-স্যালাইন পুশ করছেন, ওষুধ ও খাবার খাইয়ে দিচ্ছেন, নিয়মিত ব্লাড প্রেশার, পালস, শরীরের তাপমাত্রা এবং অক্সিজেন মেপে দেখছেন। অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা রোগীকে সব ধরনের চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন।