রংপুরের পাগলাপীর ঠাকুরপাড়া ও পীরগঞ্জ উপজেলার মাঝিপাড়ায় ধর্মীয় অবমাননা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার অভিযোগকে কেন্দ্র করে তাণ্ডবের ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলো এখন আদালতে বিচারের জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। প্রায় ৫ বছর হতে চলেছে ঠাকুরপাড়ার ঘটনা; আর বছর খানেক হলো পীরগঞ্জের মাঝিপাড়ায় হামলার ঘটনা ঘটে। কিন্তু বিচার কার্যক্রম চলছে শম্বুকগতিতে। নানাবিধ জটিলতা, সাক্ষীদের অনাগ্রহ ও ভয়ভীতির কারণে ধীরগতিতে চলছে এসব মামলার কার্যক্রম।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির রংপুর জেলা সভাপতি ডা. মফিজল ইসলাম মান্টু বলেন, সাম্প্রদায়িক সহিংসতার মামলাগুলো চলে খুবই ধীরে- যা দুঃখজনক। এসব মামলার বিচার কাজ দ্রুত শেষ করা না হলে সংশ্লিষ্টদের মনে শঙ্কা থেকেই যায়। এই শঙ্কা পূজাপার্বণের পরিবেশকেও মলিন করতে পারে। তাই বিচারিক কাজ দ্রুত শুরু করে তা শেষ করে সব ধর্মের মানুষকে আস্থায় নিতে হবে। তিনি আশা করেন, সম্প্রীতি বজায় রেখে আগামী পূজা হবে আনন্দ-উৎসবের।
আসন্ন পূজায় রংপুরে কোনো শঙ্কা দেখছেন না বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের জেলা সভাপতি সুশান্ত ভৌমিক। তিনি মনে করেন, পূজা হবে নির্বিঘ্নে এবং আনন্দমুখর পরিবেশে।
তিনি জানান, বিষয়টি নিয়ে গত রবিবার জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় কথা হয়েছে। সেখানে প্রশাসনের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিতসহ সার্বিকভাবে সহযোগিতার বিষয়টি উঠে এসেছে। তাদের পরিষদের পক্ষ থেকেও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবিরা কাজ করবে পুরো দুর্গোৎসবকে ঘিরে। প্রয়োজনে কন্ট্রোল রুম করা হবে প্রতিটি উপজেলা কমিটির সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের জন্য।
উল্লেখ্য, গত ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগ এনে ঠাকুরপাড়ায় তাণ্ডব চালায় একদল দুর্বৃত্ত। এ ঘটনায় দুটি মামলা দায়ের হলে পুলিশ প্রায় দেড়শজনকে গ্রেপ্তার করে। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এর আগে ৫ নভেম্বর রংপুর সদরের ঠাকুরপাড়া এলাকার মৃত খগেন রায়ের ছেলে টিটু রায় ফেসবুকে ধর্মীয় অবমাননাকর স্ট্যাটাস দিলে ৬ নভেম্বর টিটু রায়ের বিরুদ্ধে রংপুর সদর উপজেলার খলেয়া ইউনিয়নের শলেয়াশাহ গ্রামের মুদি দোকানি রাজু মিয়া গঙ্গাচড়া থানায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনে একটি মামলা করেন। এরই জের ধরে সদর উপজেলার পাগলাপীর ঠাকুরপাড়া হিন্দু গ্রামে হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়। এতে পুলিশের গুলিবর্ষণে একজন মারা যান। এ সময় পলিন চন্দ্র রায়, কৈশরী বালা এবং নূপুর চন্দ্র রায়সহ হিন্দু সম্প্রদায়ের বেশ কয়েকজনের বাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়।
আর ২০২১ সালের ১৭ অক্টোবর রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার মাঝিপাড়ায় সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ১৮ অক্টোবর পীরগঞ্জ থানার এসআই ইসমাইল হোসেন বাদী হয়ে ১৪৬ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন। তদন্ত শেষে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সব আসামির বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। মামলার প্রধান আসামি শহিদসহ শতাধিক আসামি দীর্ঘদিন ধরে পলাতক ছিল।
মামলায় দীর্ঘ ৯ মাস পর প্রধান আসামি শহিদ ওরফে শহিদুজ্জামান মণ্ডলসহ ৫১ আসামি গত ৭ আগস্ট আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করলে বিচারক তাদের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। ফেসবুকে ধর্ম অবমাননাকর স্ট্যাটাস দেয়াকে কেন্দ্র করে ২০২১ সালের ১৭ অক্টোবর পীরগঞ্জের বড় করিমপুর কসবা মাঝিপাড়া ও দক্ষিণমাঝি পাড়ার সংখ্যালঘুদের বাড়িতে সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়ে অতন্ত ৩০টি ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটায়। এ ঘটনায় আইসিটি আইনে ৩টি ও মাঝিপাড়ায় তাণ্ডবের ঘটনায় একটিসহ মোট ৪টি মামলা করে পুলিশ। ঘটনার পর জড়িত সন্দেহে অনন্ত ৫০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এ ব্যাপারে জেলা জজ আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট আব্দুল মালেক বলেন, ঠাকুরপাড়ায় তাণ্ডবের ঘটনায় দায়ের করা মামলার অনেক আসামি এখনো পলাতক রয়েছে। এছাড়া অনেক কাজ এখনো বাকিও রয়েছে। মামলায় যাদের সাক্ষী করা হয়েছে, তারাও অনেকে সাক্ষী দিতে আসেন না। তাদের বিরুদ্ধে শিগগিরই পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়া হবে। তবে মামলা চলমান রয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে তা বিচারের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
পীরগঞ্জের মাঝিপাড়ার মামলা সম্পর্কে তিনি বলেন, এ মামলার চার্জশিট দেয়া হয়েছে। সেটিও বিচারের জন্য প্রক্রিয়াধীন।
জানা যায়, গত বছর জেলায় ৯৫৬টি মণ্ডপে শারদীয় দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়। মণ্ডপের সংখ্যা এখনো নির্দিষ্ট করা না হলেও এ বছর আরো বেশি মণ্ডপে পূজা হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
পূজা উদযাপন পরিষদের কোতোয়ালি থানা কমিটির সদস্য সচিব গৌতম রায় বলেন, পূজার আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে শঙ্কা না থাকলেও কিছু মণ্ডপ অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনের কাছে তালিকা দেয়া হয়েছে।