অভিমান করে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসার ২৮ বছর পর বাড়ি ফিরলেন বাচ্চু মণ্ডল। স্ত্রী জাহেদা বেগমের ওপর অভিমান করে কুড়িগ্রামের সদর উপজেলার পলাশপুরের বাড়ি থেকে বের হয়ে যশোরের অভয়নগরে এসেছিলেন তিনি। কিন্তু এতদিন কেউ তার ঠিকানা জানত না। দীর্ঘ ২৮ বছর পর অবশেষে বাড়ি ফিরছেন তিনি।
সম্প্রতি অভয়নগরের সুন্দলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিকাশ রায় কপিলের মধ্যস্ততায় সব মেম্বার, সাংবাদিক ও সুধীজনদের উপস্থিতিতে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে বাচ্চু মণ্ডলকে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
দীর্ঘদিন পর পরিবারকে কাছে পেয়ে আর বাড়ি যাওয়ার আনন্দে তার চোখেমুখে ছিল খুশির উচ্ছ্বাস। ওই রাতেই বাসে চড়ে ভাতিজা শফিকুল ইসলামের সঙ্গে যশোর থেকে পলাশপুর বাড়ির পথে রওনা দেন তিনি। বাসে ওঠার আগে তিনি ভাতিজার মোবাইল থেকে স্ত্রী জাহেদাকে বলেন, ‘বউ, কেমন আছিস? আমার ছেলে কেমন আছে? আমি আর রাগ নেই। আমি বাড়ি আসতেছি।’
চেয়ারম্যান বিকাশ রায় কপিল বলেন, বাচ্চু মণ্ডলের পরিবার আছে, এমন কথা তিনি কোনোদিন কাউকে বলেননি। দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে তিনি আমাদের ইউনিয়নে রয়েছেন। স্ত্রীর ওপর অভিমান করে ৩৬ বছর বয়সে বাচ্চু মন্ডল বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন। এসে ওঠেন অভয়নগরে। এখানে নওয়াপাড়া বাজারের পাশে আড়পাড়া গ্রামের নগেন্দ্রনাথ রায়ের বাড়িতে তিনি আশ্রয় নেন। থাকা-খাওয়ার শর্তে তাদের কৃষি ও বাড়ির কাজ শুরু করেন। বছর তিনেক থেকে ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামের মুকুন্দ মল্লিকের বাড়িতে যান। সেখানে দুই বছর থেকে পরে একই গ্রামের চারু মল্লিকের বাড়িতে ওঠেন।
অন্য জেলার মানুষ এ এলাকায় বসাবস করছেন, এটা জানতে পেরে সুন্দলী ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান বিকাশ মল্লিক তাকে একদিন ইউনিয়ন পরিষদে নিয়ে ২০০৬ সালের দিকে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে তাকে একটি ভ্যান উপহার দেন। সেই ভ্যান চালিয়ে তিনি জীবিকা নির্বাহ শুরু করেন।
পরে তিনি ইউনিয়ন পরিষদের অস্থায়ী পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন। সেই সঙ্গে ইউনিয়ন পরিষদের নতুন ভবনের দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষে বসবাসের সুযোগ করে দেন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান ও সদস্যরা। সেই থেকে অদ্যাবধি বাচ্চু মণ্ডলের ঘরবাড়ি সুন্দলী ইউনিয়ন পরিষদ ভবন।
এখানেই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে মিলেমিশে দীর্ঘ সময় বসবাস করেছেন তিনি। অবশেষে পরিবার তাকে সন্ধান করলে আমরা মঙ্গলবার রাতে পরিবারের সদস্যদের কাছে তাকে তুলে দিয়েছি, বলেন চেয়ারম্যান।
ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে বাচ্চু মণ্ডলকে যখন বিদায় দেওয়া হয়, তখন তিনি বলেছিলেন, আমার মা-বাবা বেঁচে নেই। চার ভাইয়ের মধ্যে আমি সেজ। স্ত্রী-সন্তান ও আত্মীয়-বন্ধুদের ফেলে দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে আমি সনাতন ধর্মের মানুষের সঙ্গে বসবাস করেছি। তারা আমাকে তাদের ভাই হিসেবে সম্মান ও শ্রদ্ধা করেছে। থাকতে-খেতে দিয়েছে, ভালো ব্যবহার করেছে। কখনো অন্য ধর্মের মানুষ হিসেবে আমাকে ঘৃণা করেনি।
তিনি আরো বলেন, আমি সুন্দলী ইউনিয়নবাসীর কাছে ঋণি। বাড়ি ফিরে গেলেও অভয়নগরের সুন্দলী ইউনিয়নে সপরিবার বেড়াতে আসব।
বাচ্চু মণ্ডলের ভাতিজা শফিকুল ইসলাম বলেন, আমার চাচি অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় চাচা নিখোঁজ হয়েছিলেন। পরে আমরা অনেক খোঁজাখুঁজি করেছি। এক পর্যায়ে চাচার আশা ছেড়েই দিয়েছি। সম্প্রতি আমাদের এলাকার গ্রাম পুলিশ অসিত বিশ্বাসের মাধ্যমে চাচার সন্ধান পাই। চাচার জাহিদুল ইসলাম নামে ২৭ বছর বয়সী এক ছেলে রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, দীর্ঘদিন পর চাচা বাড়িতে আসায় আমাদের সবার পরিবারে আনন্দ বিরাজ করছে। আমার দাদা-দাদি বেঁচে থাকলে আজ হারানো সন্তান ফিরে পেয়ে মহাখুশি হতেন।
সূত্র: ডেইলি বাংলাদেশ