উদ্বোধনের পর পরই জনতার ঢল শুরু হয় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্নের মধুমতি সেতুর ওপর। দেশের প্রথম ৬ লেনের মধুমতি সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে একটু স্বপ্নপূরণের স্বাদ গ্রহণ করার চেষ্টা। দুপুরের প্রচণ্ড রোদ দর্শনার্থীদের আটকে রাখতে পারেনি।
দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত পুরো সেতু ও তার দুই প্রান্ত জুড়ে কয়েক হাজার উৎসুক মানুষের ঢল নামে। দীর্ঘদিনের দুর্ভোগের পর কাঙ্খিত সেতুর উদ্বোধন যেন অন্যরকম আবেগ, অনুভূতিতে একাকার হয়ে গেছে। স্বপ্ন পূরণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন নানা শ্রেণি পেশার মানুষ।
মধুমতি সেতু বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে নড়াইল-গোপালগঞ্জের পাশাপাশি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীসহ প্রায় সারাদেশের সঙ্গে নতুন সেতুবন্ধন তৈরি হয়েছে।
সোমবার দুপুরে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশের প্রথম ৬ লেন বিশিষ্ট এই সেতুটির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর থেকে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। তবে টোল দিয়ে যানবাহন চলাচলের জন্য সময় নির্ধারণ করা হয় সোমবার রাত ১২টা থেকে।
সেতুর ওপর উঠতে পেরে স্বপ্ন পূরণের স্বাদ উপভোগ করেন। অনেকেই পায়ে হেঁটে লোহাগড়া প্রান্ত থেকে ভাটিয়াপাড়া মোড় পর্যন্ত চলে যান। আবার সেতুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে মধুমতি নদীর অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করেন।
দর্শনার্থী কালনা এলাকার বাসিন্দা রাব্বি বলেন, ‘আজ সেতুটি চালু হলো। সুযোগ পেয়েই সেতুর ওপর চলে এসেছি। প্রচণ্ড রোদকে উপেক্ষা করে সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে স্বপ্ন পূরণের আনন্দ উপভোগ করছি। সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে মধুমতি নদীর সৌনন্দ উপভোগ করেছি। আগে নৌকা পার হয়ে গোপালগঞ্জ এলাকায় আসতে হতো। এখন পায়ে হেঁটেই চলে এসেছি। আজকের দিনটি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্বরণীয় হয়ে থাকবে।’
দর্শনার্থী লোহাগড়া উপজেলার তালবাড়িয়া গ্রামের কাজী সোহানুর রহমান বলেন,‘ মধুমতি সেতু আমাদের স্বপ্নকে পরিপুর্ণতা এনে দিয়েছে। পদ্মাসেতু চালুর পরও নড়াইল, যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনার একটি অংশের মানুষের দুর্ভোগ রয়েছিলো কালনা ফেরীঘাট। দীর্ঘ যানজটের কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। মধুমতি সেতু চালুর মাধ্য দিয়ে দুর্ভোগ লাঘব হলো এবং স্বপ্নের পরিপূর্ণতা পেলো। এখন থেকে নড়াইলবাসীকে ঢাকা যেতে আর কোনো ফেরী পার হতে হবে না। নড়াইল থেকে মাত্র ২ ঘণ্টায় রাজধানী ঢাকায় পৌঁছাতে পারবো।’
লোহাগড়া উপজেলা পরিষদের নারী ভাইস চেয়ারম্যান ফারহানা ইয়াসমিন ইতি বলেন, ‘আমাদের চিকিৎসা সেবাসহ প্রয়োজনীয় অনেক কাজে গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, রাজধানী ঢাকাসহ ভিবিন্ন জেলায় যাতায়াত করতে হয়। এক সময় ঢাকা যেতে প্রস্তুতি নিয়ে ও খাবার সঙ্গে নিয়ে রওয়ানা হতে হতো। তখন ৮-১০ ঘণ্টা সময় লাগতো।
লোহাগড়া উপজেলা শহর থেকে ঢাকার দূরত্ব মাত্র ১১০ কিলোমিটার। এখন কোনো ভোগান্তি ছাড়া রাজধানীতে আমরা দুই ঘণ্টায় যেতে পারবো। অফিসিয়াল কাজকর্ম শেষ করে দুপুরে বাড়িতে এসেই খাবার খাওয়া যাবে।’
জেলা যুব মহিলা লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সঞ্চিতা হক রিক্তা বলেন,‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলবাসীর জন্য এ বছর দুটি উপহার দিয়েছেন। একটি হলো পদ্মাসেতু এবং অপরটি হলো মধুমতি সেতু। নড়াইল, যশোর, সাতক্ষীরা, মাগুরা ও খুলনা অঞ্চলের মানুষের জন্য সেতু দুটি বড় উপহার। এই সেতু দুটির কারণে এই অঞ্চলের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটবে। খুব সহজেই এই অঞ্চলের কৃষিপণ্য রাজধানীতে পাঠাতে পারবে। যার কারণে কৃষকরা ন্যয্য মূল্য পাবেন।
নড়াইলসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় ব্যপক পরিমাণ মাছের ঘের রয়েছে। মাছ চাষিরাও তাদের উৎপাদিত মাছ রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সহজেই বহন করতে পারবে। মৎস্যখাতেরও ভাগ্য খুলবে। এছাড়া এই সড়কের পাশ দিয়ে অসংখ্য শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠার মধ্যদিয়ে বেকারত্ব দূর হবে। এক কথায় নড়াইল জেলার ভাগ্যের দ্বারও খুলে গেলো এই সেতু চালুর মধ্য দিয়ে।
নড়াইল-২ আসনের এমপি মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা বলেন,‘ আমাদের আবেগ আর ভালোবাসার নাম পদ্মা ও মধুমতি সেতু। পদ্মাসেতু চালু হলেও মধুমতি সেতু চালু না হওয়ায় আমরা পরিপূর্ণ সুবিধা ভোগ করতে পারছিলাম না। মধুমতি সেতু চালুর মধ্যদিয়ে আমাদের সকল ধরণের ভোগান্তি কমে গেলো। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকবে। মধুমতি সেতু নির্মাণের জন্য প্রধানমন্ত্রীসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী আমাদের সরকারকে ধন্যবাদ জানাই।
জানা গেছে, সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইম্প্রুভমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে মধুমতি সেতু নির্মিত হয়েছে। নেলসন লোস আর্চ টাইপের (ধনুকের মতো বাঁকা) সেতু এটি। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৬৯০ মিটার এবং প্রস্থ ২৭ দশমিক ১ মিটার। উভয় পাশে ছয় লেনের সংযোগ সড়ক প্রায় সাড়ে ৪ কিলোমিটার। সেতু নির্মাণে মোট ব্যয় প্রায় ৯৬০ কোটি টাকা। এশিয়ান হাইওয়ের ওপর অবস্থিত এটি।
সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সিলেটের তামাবিল হয়ে ঢাকা, ভাঙ্গা, নড়াইল, যশোর, বেনাপোল, কোলকাতা পর্যন্ত সরাসরি ভূমিকা রাখবে। তবে এতোদিন কালনা পয়েন্টে মধুমতি নদী ধারা বিচ্ছিন্ন ছিল। সেতু নির্মাণের ফলে সেই বিছিন্নতা নেই। কালনা সেতু চালু হলে শুধু জাতীয় ক্ষেত্রে নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। ভারত, কলকাতা, আসামসহ দেশের মধ্যে সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর, বেনাপোল ও নোয়াপাড়া নদীবন্দরের মধ্যে যোগাযোগের মাইলফলক রচিত হবে।
নড়াইলের লোহাগড়ায় ইপিজেড (রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল) চালুসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ও ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। সেতুর উদ্বোধনের অপেক্ষায় ছিলেন গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, নড়াইল, যশোর, বেনাপোল, সাতক্ষীরাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলার কোটি কোটি মানুষ। আজ তাদের স্বপ্ন পূরণ হলো। এ সেতু চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাণিজ্যিক বিপ্লব ঘটবে। ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কালনা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন।