“ব্যবস্থাপক যাহা করেন তাহাই ব্যবস্থাপনা” (পর্ব-২)

ড. মীজানুর রহমান
  ০২ মার্চ ২০২২, ১০:২০

“বাজারজাতকরণ ব্যবস্থাপনা”

ব্যবস্থাপকের কাজ হচ্ছে 'ম্যানেজ' করা বা সমস্যা সমাধান করা।  স্বভাবতই  বাজারজাতকরণ ব্যবস্থাপকের কাজ  হচ্ছে বাজারজাতকরণ সমস্যা সমাধান করা।  যেহেতু গত পর্বে ব্যবস্থাপনার সংজ্ঞা নিয়ে আলোচনা করেছি অতএব বাজারজাতকরণেরও  সংজ্ঞা নিয়েও আলোচনা  প্রয়োজন।  কোন শাস্ত্রের সংজ্ঞা দেয়া সত্যিই কঠিন। প্রত্যেকেই নিজের মতো করে সংজ্ঞা দেন। দর্শন,  রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, শিল্পকলা বা এধরনের  যে কোন শাস্ত্রের একটি পাঠ্যবই (বাজারে প্রচলিত কলেজ পর্যায়ের) খুললেই দেখা যাবে বইটি শুরু হয়েছে বেশ কয়েকটি সংজ্ঞা দিয়ে। সংজ্ঞাগুলোর মধ্যে  পরস্পর বিরোধীতা থাকায় পাঠকদের বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিছু কিছু সংজ্ঞা এত সাংঘর্ষিক যে বিভ্রান্ত হতে আপনি বাধ্য হবেন। মার্কেটিংয়ের বহু লেখক বহু সংজ্ঞা দিয়েছেন। 

(উচ্চমাধ্যমিক এবং ডিগ্রি পর্যায়ের মার্কেটিং এর বই এবং পরীক্ষার্থীদের খাতায় আমার নামও পেয়ে যেতে পারেন,   মার্কেটিংয়ের সংজ্ঞাদাতা  হিসেবে। পরীক্ষার্থীদের খাতায় আমি নিজেই নিজের নাম দেখেছি। আমার নামের  আগে এমন বিশেষণও দেখেছি,  যা দেখে বরিশালের 'গাবখান'  খালকে  'ইংলিশ চ্যানেল' এর সাথে তুলনা বলে মনে হয়েছে। নিশ্চয়ই গাইড প্রণয়নকারী কোন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক,  আমার ছাত্রও হতে পারে,  নিজের মতো কিছু একটা লিখে আমার নামে চালিয়ে অতি ভক্তি প্রদর্শনের চেষ্টা করেছেন। আমি কিছু লিখলে বা বললে সেটাকে অনেকেই, বিশেষ করে আমার ছাত্ররা, অকাট্য বলেই ধরে নেয়। যদিও আমি ছাত্রদেরকে সবসময় বলি আমি যা যা লিখছি বা বলছি এগুলোর কোনটাই পুরোপুরি সত্য না, 'আপাতত সত্য'।  আসল সত্য জানিনা বলেই এগুলো সত্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর "প্রাচ্য সমাজ" প্রবন্ধে যেমনটি বলেছেন,  "আমাদের পূর্বাঞ্চলে প্রকৃতির পদতলে অভিভূতভাবে বাস করিয়া প্রত্যেক মানুষ নিজের অসারতা ও  ক্ষুদ্রতা অনুভব করে,  এইজন্য কোন মহৎ লোকের অভ্যুদয় হইলে তাহাকে স্বশ্রেণি হইতে সম্পূর্ণ পৃথক করিয়া দেবতা পদে স্থাপিত করে। তাহার পর হইতে তিনি যে কয়টি কলা বলিয়া গিয়েছেন  বসিয়া বসিয়া তাহার অক্ষর গণনা করিয়া জীবনযাপন করি; তিনি সামাজিক অবস্থার উপযোগী যে বিধান করিয়া গিয়াছেন তাহার রেখা মাত্র লংঘন করা মহাপাতক জ্ঞান করিয়া থাকি")।

মার্কেটিংয়ের বিখ্যাত পণ্ডিতদের দেয়া  সংজ্ঞাগুলোর মধ্যে  বেশ রোমান্টিক  সংজ্ঞাও  আছে। Paul Mazur মার্কেটিংয়ের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, " Marketing is the delivery of standard of living" । পরবর্তীতে Prof. McNair এই সংজ্ঞাটিতে  গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনে লিখেছেন, " Marketing is the creation and delivery of standard of living to the society." । একজন লেখক তাঁর বইয়ের প্রত্যেক সংস্করণে সংজ্ঞা বদল করেছেন এমনও আছে।  ফিলিপ কটলার এর Marketing Management বইটির ষোড়শ  সংস্করন চলছে। এই বইটি আমার নিজের "ব্রেড আর্নার"   হওয়ার কারণে  বইটির সবকটি সংস্করণ আমার সংগ্রহে আছে।  প্রত্যেক সংস্করেনেই কটলার  তাঁর পূর্ববর্তী সংস্করনে দেয়া মার্কেটিং এর সংজ্ঞাটি বদল করেছেন।  

পাঠকদের অনেকেই জানেন ফিলিপ কটলার দুইবার ঢাকা এসেছিলেন। ফিলিপ কটলারকে ঢাকায় আনার ব্যাপারে আমার বন্ধু অধ্যাপক ড. ফরহাদ আনোয়ার এর সাথে আমিও সংশ্লিষ্ট ছিলাম।  দ্বিতীয়বার যখন কটলার ঢাকা আসলেন আমার দায়িত্ব ছিল কটলারের সাথে সাথে থাকা;  এয়ারপোর্ট টু এয়ারপোর্ট।  আমি রিসিভ করব এবং বিদায় জানাব। এয়ারপোর্টে পৌঁছার পরেই  কটলারকে নিয়ে ভিআইপি লাউঞ্জে বসলাম,  ইমিগ্রেশন ও লাগেজ ফর্মালিটিস সম্পন্ন করার জন্য। সামান্য কুশল বিনিময়ের পরেই ফিলিপ কটলার আমাকে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন-  আমাদের অর্থনীতি,  রাজনীতি, আমদানি-রপ্তানি, আরএমজি... ইত্যাদি  বিষয়ে। একটা ছোট কলম বাম হাতে নিয়ে ডান হাতের নোটবুকে সবকিছু লিখেছিলেন।  পরবর্তী দুই দিন কটলারের একই কাজ । একটু সুযোগ পেলেই তিনি আমাকে প্রশ্ন করা শুরু করেন। দ্বিতীয় দিন প্রোগ্রামে একটা লম্বা বিরতি পাওয়া গেল।  সোনারগাঁও হোটেলে আমরা দুজন বসে চা খাচ্ছিলাম। কিন্তু বুড়োর প্রশ্ন আর নোট নেয়া কিছুতেই থামছে না । এক পর্যায়ে আমার মনে হল, গত দুইদিন যাবত আমাকে অনবরত প্রশ্ন করে যাচ্ছেন আর আমি উত্তর দিচ্ছি,  পাল্টা একটা প্রশ্নও করলাম না, উনি যদি আমাকে বোকা ভাবেন।  তাই একটা প্রশ্ন করলাম,  Mr. Kotler,  "what do you mean by marketing? " 

(এক বোকাকে শশুর বাড়ি গিয়ে বোকামি না করার জন্য তাঁর মা পরামর্শ দেয় এবং বলে দেয় সব সময় চুপচাপ বসে থাকবি না।  কথাবার্তা বলবি। কথাবার্তা না বললে শ্বশুরবাড়ির  লোকজন তোকে বোকা মনে করবে। ওই বোকা নাকি তাঁর  শ্বাশুড়ীকে প্রথম প্রশ্নই করেছিলো,  "আম্মা, আপনার কি বিয়ে হয়েছে?")

আমার প্রশ্নটা বোকার মতো হলেও  উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। যেহেতু ইতোমধ্যেই বহুবার কটলার নিজের দেয়া সংজ্ঞা নিজেই বদল করেছেন,  প্রকৃতপক্ষে এই মুহূর্তে মার্কেটিং নিয়ে তিনি কী ভাবছেন তা জানা দরকার। কটলার আমাকে যা বলেছিলেন তা হচ্ছে,  "it is all about establishing and maintaining relationship"।  সম্পর্ক তৈরি করা এবং টিকিয়ে রাখাটাই মার্কেটিং।  পৃথিবীর যাবতীয় সম্পর্কই বিনিময় ভিত্তিক।  'exchange relationship' -এই বাক্যাংশটির  দুটি শব্দই বহুবাচনিক শব্দ,  এই অর্থে যে বিনিময়ের জন্য ন্যূনতম দুই পক্ষ লাগে, যদিও বহুপাক্ষিক বিনিময় সম্ভব। আর সম্পর্ক তো নিজের সাথে নিজে করা যাবেনা,   অন্তত আরেকটা পক্ষ থাকতেই হবে। একজন দিবে,  অন্যজন নিবে । অনেক সময় আমাদের মনে হয় অনেক কিছুই আমরা নিঃস্বার্থভাবে করি। শুধুই দেই, নেইনা । আসলে আমরা কিছু না পেয়ে কিছুই দেই না।  মা তাঁর শিশুকেও ফ্রী দুধ খাওয়ান না। কোন ব্যাপারে অবোধ্য হলেই মা দুধের খোঁটা দিতেন। "এত কষ্ট করে তোকে পালছি, বড় করছি, দুধ খাওয়াইছি..."  ইত্যাদি ইত্যাদি। আরো রাগানোর জন্য দুষ্টামি করে বলতাম, আমি কি জন্ম থেকেই কথা বলতাম?  দুধ খেতে চেয়েছি?  তোমাকে তো আমি দুধ খাওয়ানোর কথা বলিনি?  মা বলতেন, "তুমি তো তখন দুধ খাওয়ার জন্য শুধু 'কানতা' (কান্না)"। আমি বলতাম দুধ খাওয়ার পর কি করতাম?  "ও বাবা, তখন তোমার হাসি কে দেখে"! আমি বলতাম আমার হাসি দেখে তোমার কেমন লাগতো? এটা বললেই মা হেসে দিতেন । আমি বলতাম আমার ওই হাসিটাই তোমার দুধের দাম (পেমেন্ট হয়ে গেছে!)। ব্যাপারটা উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করলাম। 

আসলে পৃথিবীর কোন সম্পর্কই বিনিময় ছাড়া হয় না। বিনিময়ের প্রধান শর্ত দুটি- প্রথমটি হচ্ছে  বিনিময়ের জন্য কমপক্ষে দুটি পক্ষ থাকতে হবে,  অন্যটি হচ্ছে বিনিময়টি আপসের এর মাধ্যমে হতে হবে। জোরাজুরি করে কিছু বিনিময়ে হলেও সেটা বিনিময় না। যেমন ছিনতাইকারী আপনাকে একটি থাপ্পর দিল,  আপনি তাকে ১০০ টাকা দিলেন।  দুই পক্ষ ছিলেন, আপনি এবং ছিনতাইকারী,  থাপ্পর আর টাকার বিনিময়ও হলো । কিন্তু এটা বিনিময় না। যেহেতু সেটা আপসে হয়নি।  প্রশ্ন হচ্ছে দুই পক্ষ যখন আপসে কিছু বিনিময় করার সুযোগ পায়,  তখন তারা কি বিনিময় করে? বিনিময়ের সুযোগ আসলেই তাঁরা পরস্পরে নিড(need) বিনিময় করে।  নিড হচ্ছে মনোদৈহিক অবস্থা,  যখন মানুষ নিজকে কোন কিছু থেকে বঞ্চিত বোধ করে ( a state of felt deprivation ) । যাদের নিড বুঝতে অসুবিধা তাঁদেরকে drive শব্দটি বুঝতে বলি,  যার অর্থ হচ্ছে তাড়না ।   'তাড়না'  বুঝতে যাদের অসুবিধা, তাঁদের জন্য কাছাকাছি শব্দ হচ্ছে 'যাতনা' । যাতনার সংজ্ঞা দেয়ার দরকার নেই। জীবনে যত যাতনায় পড়েছেন,  তাকেই যাতনা বলে। এই লেখাটা যারা ক্ষুধার্ত অবস্থায়  পড়ছেন,  তারা বুঝতে পারছেন যাতনা কাকে বলে। প্রত্যেকটি পণ্য হচ্ছে ভোক্তার যাতনার একটি সমাধান। 

যদিও মার্কেটিং একটি ব্যবসায় শাস্ত্র,  ব্যবসায় অনুষদেই মার্কেটিং পড়ানো হয়;  "সম্পর্ক স্থাপন ও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা"  এই সংজ্ঞাটি  ধরলে মার্কেটিং ব্যবসায় ডিসিপ্লিন এর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই।  শতশত প্রতিষ্ঠান যারা কোন ব্যবসায় করে না,  বা মুনাফা অর্জনের জন্য কাজ করে না  তাঁরাও এখন মার্কেটিংকে ব্যবহার করছে। যেখানেই সম্পর্কের ব্যাপারটা আসবে সেখানেই মার্কেটিং কথাটি বৈধ । সম্পর্ক সৃষ্টির জন্য প্রথমেই প্রয়োজন প্ররোচনামূলক যোগাযোগ (persuasive communication),  এবং সম্পর্ক দৃঢ় ও স্থায়ী করার জন্য প্রয়োজন পারস্পরিক সন্তুষ্টি এবং আনুগত্য।  যে কোন প্রতিষ্ঠানের মূল মার্কেটিং সমস্যা হচ্ছে তার কাস্টমার,  ক্লায়েন্ট,  পার্টনার এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা এবং তা দৃঢ় করা।  ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বললেও বলা যায় কোম্পানির সাথে যদি তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সম্পর্ক মজবুত  হয় অর্থাৎ সংশ্লিষ্টরা যদি এমন মনে করে, তাঁরা যা চায় কোম্পানির তাই করছে, অথবা কোম্পানির যা করছে সেটাই যদি  স্টেকহোল্ডাররা  পছন্দ করে, তাহলে কোম্পানির বাজারজাতকরণ ব্যবস্থাপকের আর বেশি কিছু করতে হবে না। অতএব সম্পর্ক স্থাপন করা এবং টিকিয়ে রাখাই বাজারজাতকরণ ব্যবস্থাপকের কাজ। সনাতন মার্কেটিং থেকে শুরু করে ইদানীংকালের   যত মার্কেটিং আছে যেমন- ডিজিটাল মার্কেটিং,   এফিলিয়েট মার্কেটিং, ইনফ্লুয়েন্সার  মার্কেটিং,  সার্চ ইঞ্জিন মার্কেটিং,  ই-মেইল মার্কেটিং,  নিউরো মার্কেটিং,  গেরিলা মার্কেটিং, গরিলা মার্কেটিং, বানর মার্কেটিং(Agile Marketing), মার্কেটিং অ্যানালিটিকস এগুলো কোনটাই সম্পর্ক স্থাপনের মার্কেটিং ছাড়া আর কিছুই না।

দ্বিতীয় পর্ব

লেখক: অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়