দেশভাগের মধ্যে দিয়ে ব্রিটিশ মানচিত্র বিচ্ছেদকারী রেডক্লিফ পূর্ববাংলাকে যখন সূদুর পাকিস্তানের সাথে অসম প্রণয়ের শিকলে বেঁধে দিলেন ঠিক সেই মুহূর্তে পূর্ববাংলার জনসাধারণ ভূমির সেই যোগসূত্রহীন অদৃশ্য বন্ধনকে সম্মিলিত ভাবে ও একত্রিত চিত্তে নাকচ করে দেয়। ঠিক সেই মুহূর্তে বাংলার জনগণ নিজেদের উপর অযাচিত ভাবে চাপিয়ে দেওয়া বস্যতার বিরুদ্ধে মানসিক ভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়।
সেই অযাচিত জোরপূর্বক অসম অস্তিত্ব নামক দেশ বন্টণের মধ্যে দিয়ে বাঙালিকে যে সার্বিক ভাবে দাসত্বের জালে বন্দী করার পাঁয়তারা চলছে এটা বুঝতে বাঙালির খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। আর সেই চাপিয়ে দেওয়া ব্রিটিশ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দানা বাঁধা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অপমান, অনাদর ও তাচ্ছিল্যের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়াসে সাংগঠনিক ভাবে বাঙালি একতাবদ্ধ হওয়ার প্রয়াসে এগিয়ে যায়।
বাঙালির সেই প্রথম মুক্তির নিমিত্তে সাংগঠনিক ভাবে সর্বপ্রথম একতাবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে যে দলটি আত্মপ্রকাশ করে তার নামই " বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ " বাঙালির অস্তিত্বের সাথে সাংগঠনিক ভাবে যে দলটির প্রাণরস গভীর প্রাণশক্তিতে মিশে আছে তার নামই "বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ"
সেই অযাচিত চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাঙালি তার অস্তিত্বের মেরুদণ্ডের দৃঢ়তার জানান দিতে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার কে এম দাস লেনে অবস্থিত ঐতিহাসিক ‘রোজ গার্ডেন’ প্রাঙ্গণে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুসারী মুসলিম লীগের প্রগতিশীল কর্মীদের নিয়ে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে "পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ" নামে পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। সংগঠনটির প্রথম কমিটিতে মওলানা ভাসানী সভাপতি ও শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং জেলে থাকা অবস্থায় যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই হয়ে উঠে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রাণপুরুষ ও দিকপাল।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ধর্মনিরপেক্ষ-অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, শোষণমুক্ত সাম্যের সমাজ নির্মাণের আদর্শ এবং একটি উন্নত সমৃদ্ধ আধুনিক, প্রগতিশীল সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা বিনির্মাণের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দর্শনের ভিত্তি রচনা করে দলটি। যার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৫ সালের কাউন্সিলে অসাম্প্রদায়িক নীতি গ্রহণের মাধ্যমে সংগঠনটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’।
আওয়ামী লীগ শুধু এ দেশের প্রাচীন ও সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক সংগঠনই নয়, বাংলাদেশের রাজনীতির মূলধারাও। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ইতিহাস একসূত্রে গাঁথা। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ভাষা সংগ্রামের পথ ধরে ৬৬ সালে ৬ দফা, ৬৯-এর গণআন্দোলনসহ দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করে বাঙালি জাতি। পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ এই তিনটি শব্দ যেন এক কেন্দ্র অবস্থান করা গভীর যোগসূত্রের অভিন্ন প্রকাশ। একটি আরেকটির সাথে যেন মিলেমিশে নির্মাণ করেছে একক কোন পরম সত্তা।
৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান তখন কারারুদ্ধ। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রসমাজ কর্তৃক ১৪৪ ধারা ভঙ্গের কর্মসূচির সঙ্গে কারাগারেই তিনি একাত্মতা প্রকাশ করে অনশন করেন। ৫৩-এর ১৪ নভেম্বর ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের বিশেষ কাউন্সিলে ২১ দফার ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।
পরবর্তীতে পাকিস্তানের অযাচিত চাপিয়ে দেওয়া শোষণের বিরুদ্ধে ৬৬-তে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ছয় দফা ছিল প্রথম স্বাধীনতার বিমসৃণ পথে প্রথম সাঁকো। এই সাঁকো দিয়েই আমরা স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হয়ে ছিলাম।
পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক উজ্জ্বল ভূখণ্ডের যে প্রতিবিম্ব আমরা দেখতে পাই সেই অর্জনের পেছনে যে সংগঠন বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে তার নাম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং যিনি তার দক্ষ নেতৃত্বের মাধ্যমে স্বাধীনতার সোপান নির্মাণ করেছিলেন তিনি বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৭০ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নৌকা প্রতীকে নির্বাচন এবং জনগণের সার্বিক সমর্থনে যে বিজয় অর্জন করে তার মধ্যে দিয়েই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের দাবির শেষ পেরেকটা মারা হয়ে যায় পাকিস্তানের বর্বর শাসক গোষ্ঠীর নির্মম হস্তে। এর মধ্যে দিয়েই শুরু হয় স্বাধীনতা ও নিজেদের মুক্তির আকাশ ভাঙা সম্মিলিত চিৎকার।
বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আমরা বাঙালি জাতি পরিনত হই একটি সামগ্রিক একক হস্তে। যে হস্তের দাপটে চুরমার হয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পাষাণের প্রাচীর।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাসহ বাঙালি জাতির যা কিছু শ্রেষ্ঠ অর্জন, তার মূলে রয়েছে জনগণের এই সংগঠনের প্রতি ভালোবাসা ও আত্মিক সমর্পণ। জন্মলগ্ন থেকে এখনও পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শক্তির উৎস জনগণ এবং সংগঠনের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট একদল সেনাসদস্য ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে ঢুকে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ পরিবারের ১৭ জন,নিকট আত্মীয় ৯ জনসহ সর্বমোট ২৬ জন সদস্যকে নির্মম ভাবে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা তখন জার্মানিতে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভেতর নানান টালমাটাল পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে থাকে। কিন্তু জনগণের অদম্য প্রত্যাশা এবং তার প্রতি আহ্বানকে বঙ্গবন্ধু কন্যা উপেক্ষা করতে পারেননি। তাই জনগণের সার্বিক প্রত্যাশা পূরণ এবং অগোছালো ছিন্নভিন্ন এক বাংলাদেশে ফিরে আসেন তিনি। বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে মাতৃভূমিতে ফিরে এসে শক্ত হাতে হাল ধরেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের। তারপর থেকেই পথচলা শুরু এখনো মানুষের সাথে মিলেমিশে কাজ করে যাচ্ছেন দেশ ও দেশের জনগণের সার্বিক কল্যানে।
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত স্বপ্ন বাস্তবায়নের কল্পে নিজের সবটুকু উজার করে দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। মানুষকে করেছেন নিজের পরিবারের মত আপনজন। সমগ্র বাংলাদেশটাই যেন তার নিজের আপন পরিবার এবং জনগণ তার সেই পরিবারের সদস্য।
দলের সভাপতি হওয়ার পর থেকেই দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে নিজের পরিবারের মতই আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করেন শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালে প্রথম, ২০০৮ সালে দ্বিতীয়, ২০১৪ সালে তৃতীয়, ২০১৮ সালে চতুর্থ এবং ২০২৪ সালে পঞ্চমবারের মত নির্বাচনে জয় লাভ করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিজের সবটুকু উজার করে দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। যে বয়সে মানুষ জীবনের অবসরে নিভৃতে সময় কাটান সে বয়সে তিনি রাতদিন এক করে কাজ করে যাচ্ছেন মানুষের কল্যানের জন্য।
বাংলার মাটি ও মানুষ যেন তার প্রতি বঙ্গবন্ধুর অর্পিত দায়িত্বের প্রতীক। বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত দিয়ে গেছেন সেই অসম্পূর্ণ স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য তার সুযোগ্য কন্যা কাজ করে যাচ্ছেন অবিরাম।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭৫ বছর পূর্তি এবং হীরকজয়ন্তীর মধ্যে দিয়ে আমাদের প্রত্যাশা, ভালো থাকুক বাংলাদেশ বিনির্মানের অন্যতম সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং ভালো থাকুক সংগঠন সংশ্লিষ্ট প্রতিটি অভিন্ন সত্তা। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিটি তৃণমূল নেতৃবৃন্দকে একত্রে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করে কাজ করে যেতে হবে।
পৃথিবীতে যত উন্নতি ও উন্নয়নের দৃশ্য রচিত হয়েছে তার পেছনে একত্রিত হৃদয় ও চিন্তার সম্মিলিত প্রচেষ্টা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আমাদেরও সকলের একত্রিতভাবে কাজ করে যেতে হবে সামগ্রিক সিদ্ধান্তে, সামগ্রিক কল্যাণে।
ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক
সভাপতি, বাগমারা উপজেলা আওয়ামী লীগ
সাবেক সংসদ সদস্য, বাগমারা-রাজশাহী