দায় এড়াতে পারবে না নতুন তালেবান

আনিস আলমগীর
  ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ২৩:২১
আপডেট  : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ২৩:২৫

নাইন ইলেভেনের দিন শপথগ্রহণের ঘোষণা করেও তালেবান গঠিত আফগানিস্তানের নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পিছিয়ে এসেছে। কারণ হিসেবে তারা গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, অভিষেক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি শেষ করা যায়নি। এছাড়া চীন-রাশিয়াসহ আমন্ত্রিত দেশগুলোর পক্ষ থেকেও আসেনি যোগদানের ইতিবাচক সাড়া। ক্ষমতা দখলের এক মাস পরেও তারা সরকারের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করতে না পারাটা ব্যর্থতা। তারচেয়েও বড় ব্যর্থতা নতুন সরকারের চেহারায় নতুনত্ব না দিয়ে পুরনো চেহারা দেওয়া। সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

কয়েক সপ্তাহ ধরে তালেবান একটি ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ সরকার উপহারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যেটি শরিয়তের সীমাবদ্ধতার মধ্যে হলেও নারীর অধিকারকে সম্মান করবে, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করবে এবং আফগানিস্তানে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে আশ্রয় দেবে না। ১৫ আগস্ট ২০২১ ক্ষমতা দখলের পর, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতৃত্ব ঘোষণা করে তালেবান। সেখানে দেখা যাচ্ছে, সরকারে স্থান পেয়েছে সব পুরুষ এবং ১৯৯৬ থেকে ২০০১-এর নৃশংস তালেবান শাসনের প্রবীণরা প্রাধান্য পেয়েছে। এরা প্রায় সবাই দেশের প্রভাবশালী জাতিগত গোষ্ঠী পশতুন, একজন এফবিআইর মোস্টওয়ান্টেড তালিকায় রয়েছেন, চার জন এক দশকেরও বেশি সময় গুয়ান্তানামো বে কারাগারে কাটিয়েছেন এবং অধিকাংশই জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছেন।

এদের মধ্যে সীমান্ত ও উপজাতীয় বিষয়ক নতুন মন্ত্রী মোল্লা ফজল ও মোল্লা নরুল্লাহ নুরিকে মনে করা হয়, তালেবানরা যখন ক্ষমতায় ছিল তখন তারা হাজার হাজার সংখ্যালঘু শিয়াকে হত্যা করেছিল। নতুন গোয়েন্দা প্রধান আব্দুল হক ওয়াসিকের বিরুদ্ধে আল কায়েদার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী মোল্লা খায়রুল্লাহ খাইরখোয়াকে ফাঁস হওয়া মার্কিন সামরিক নথিতে আফগানিস্তানের আফিমের অন্যতম মাদক সর্দার হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। খোস্টের নতুন গভর্নর মোহাম্মদ নবী ওমারি হাক্কানি নেটওয়ার্কের সন্দেহভাজন নেতা।

তারা কাবুলে স্বাধীনতার দাবিতে নারীদের বিক্ষোভের সংবাদ সংগ্রহ করেছে এই অপরাধে দুই সাংবাদিককে বর্বর কায়দায় পিটিয়েছে। এসবের মাধ্যমে তালেবান গোষ্ঠী বার্তা দিলো যে আমরা বদলাইনি।

১৫ আগস্ট তালেবানের কাবুল দখলের পর মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর সঙ্গে ২০ বছরের যুদ্ধের বিজয়ী সমাপ্তি ঘটেছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, মোল্লারা আন্তর্জাতিক উদ্বেগকে কোনও ছাড় দিয়ে তাদের কাঙ্ক্ষিত সপ্তম শতাব্দীর ইসলামি আমিরাতি শাসনের দৃষ্টিভঙ্গিকে দুর্বল করতে চাচ্ছে না। মনে হয় তারা ভাবছে যে দু'দশকের রক্তক্ষয়ী সংঘাত থেকে তালেবান এগিয়ে যাবে বলে পশ্চিমা বিশ্ব যেভাবে আশান্বিত হয়েছে, সেটাই তাদের বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা আনার জন্য যথেষ্ট।

মনে হচ্ছে তালেবানের পাশাপাশি পশ্চিমাদের জন্যও এটি একটি পরীক্ষা। যদি আফগানিস্তানের জনগণ আরও একবার নিপীড়নের শিকার হয়, তাহলে বৈদেশিক সাহায্য ও স্বীকৃতির জন্য ক্ষুধার্ত তালেবানকে অবশ্যই পরাভূত হতে হবে। নয়তো মানবাধিকারের সর্বজনীন নিয়মগুলোর কোনও মানে হবে না। এমনকি দেশে কোনও সৈন্য বা দূতাবাস না থাকলেও কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক সব ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের সুযোগ উন্মুক্ত থাকবে।

তালেবান আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর দেশটিতে অর্থপ্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের প্রায় এক হাজার কোটি ডলার আটকে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে জরুরি সহায়তা তহবিলের ৪৪ কোটি ডলারও আটকে দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। আফগানিস্তান সম্পর্কিত জাতিসংঘের বিশেষ দূত ডেবোরাহ লিওনস গত ১৪ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে আফগানিস্তানে অর্থপ্রবাহ চালুর একটি উপায় বের করার অনুরোধ জানিয়েছেন। এমন প্রেক্ষাপটে দেশটি মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে।

শুরু থেকে এখন পর্যন্ত তালেবানের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তারকারী দেশগুলোর মধ্যে কাতার অন্যতম। তালেবান ক্ষমতা দখলের পরে প্রথম বিদেশি অতিথি হিসেবে ১২ সেপ্টেম্বর কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আব্দুলরহমান আল থানি আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল সফর করে নবগঠিত তালেবান সরকারের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী মোল্লা মোহাম্মদ হাসান আখুন্দ, সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই ও দেশটির জাতীয় পুনর্মিলন পরিষদের প্রধান আব্দুল্লাহ আব্দুল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

দীর্ঘ সময়ব্যাপী কাতারের রাজধানী দোহায় আমেরিকা ও তালেবানের মধ্যে শান্তি আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ছিলেন বিশেষ মার্কিন দূত জালমে খলিলজাদ আর তালেবানদের পক্ষে ছিলেন তালেবান উপনেতা মোল্লা আবদুল গনি বারাদার। বারবার ভেঙে যাওয়া আলোচনা জোড়া লাগিয়েছে কাতার। শেষ পর্যন্ত ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ উভয় পক্ষ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। বর্তমান সমস্যা থেকে নতুন তালেবানদের উদ্ধারে কাতার কতটা সফল হয় এখনও দেখার আছে।

আফগানদের পূর্ব পুরুষের নাম ‘আফাগেনা’, যিনি বনি-ইসরাঈলের বাদশা তালুতের পৌত্র ছিলেন। আফগানরা ইহুদি বংশোদ্ভূত জাত। এ জন্য পশতু ভাষায় বহু হিব্রু শব্দের সংমিশ্রণ ঘটেছে। আফগানরা যে ইসরায়েলের পুত্রগণের শাখা-প্রশাখা, এ কথা তার এক লেখায় বলেছেন আল্লামা ইকবাল।

ইহুদি বংশধারার লোকেরা রক্ষণশীল। অত্যন্ত আধুনিক ধ্যান-ধারণার মানুষ হয়েও ইহুদিরা ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। তালেবানরাও দেখা গেছে যে ধর্মীয় অনুশাসনে অনুরক্ত। কিন্তু তাদের আধুনিক ধ্যান-ধারণা সীমিত। তালেবানদের এই বোধোদয় হলে ভালো হতো যে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তারা সারা জীবন যুদ্ধ করেও পারবে না। কাতারের শান্তিচুক্তি তাদের জন্য সর্ব অবস্থায় মানা ‘ওয়াজিব’। কী কূটনৈতিক, কী ধর্মীয়- উভয় দিক থেকে পালনীয় কর্তব্যকে অবহেলা করলে তালেবান গোষ্ঠী আবারও পিছিয়ে যাবে। তারা সবকিছু যুদ্ধের আয়না দিয়ে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এ কারণে তারা সব সময় দৌড়ের ওপর থাকছে।

তালেবানদের অস্থায়ী রাজধানী ছিল হেলমান্দ প্রদেশের মুসাকালা। সে এলাকা আফিম ব্যবসার জন্য বিখ্যাত। দুনিয়ার ৯০ শতাংশ আফিম উৎপাদন হয় আফগানিস্তানে। তালেবানদের প্রধান আয়ের উৎস হচ্ছে আফিম। আফিম ব্যবসার টাকা দিয়ে তালেবানরা চলে, অথচ এই ব্যবসার রোজগারের বৈধতা নিয়ে ইসলামি পণ্ডিতদের মাঝে বিতর্ক রয়েছে। বিতর্কজনক রোজগার থেকে বিরত থাকা খোদাভীতির লক্ষণ। ক্ষুধার্ত মানুষের মৃত প্রাণীর মাংস খাওয়া জায়েজ, এমন সিদ্ধান্তে যদি তালেবানরা আফিম ব্যবসার টাকা ব্যবহার করে থাকে, তবে অনুরূপ সিদ্ধান্তে আধুনিক জীবন ব্যবস্থা গ্রহণ করাও জায়েজ। কারণ, মুসলিম সমাজ আধুনিক জীবন ব্যবস্থা থেকে পিছিয়ে গেলে হারিয়ে যাবে। অথচ তালেবানরা আধুনিকতাকে গ্রহণ করতে খুবই শঙ্কিত। আধুনিকতাকে গ্রহণ করলে তারা আফিমের অবৈধ চাষ থেকে বৈধ চাষের দিকেও হাঁটতে পারে।

ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক শের শাহ সুরি ছিলেন আফগানেরই সন্তান। যে জাতির আত্মগ্লানির পরিবর্তে আত্মবিস্মৃতির প্রাদুর্ভাব হয়, সে জাতি আর টিকে থাকে না। এখন আফগানদের টিকে থাকার জন্য নিজেদের মাঝে বিরোধের অবসান ঘটিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে নতুন তালেবান সরকারের ভূমিকা রয়েছে সবচেয়ে বেশি। নয়তো যুদ্ধে যুদ্ধে দিন যাবে তাদের।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়