স্কুল আর লেখাপড়া নিয়ে একেবারে বিপরীত দুটি উদাহরণ। একটি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের। আরেকটি টমাস আলভা এডিসনের।
গ্রামের পাঠশালায় গুরুমশাইয়ের প্রিয় ছাত্র ছিলেন বিদ্যাসাগর। আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘আমার বিলক্ষণ স্মরণ হইতেছে, পাঠশালার সকল ছাত্র অপেক্ষা আমার ওপর তাঁহার অধিকতর স্নেহ ছিল।’ বিদ্যাসাগরকে লেখাপড়া করানোর উদ্দেশ্যেই তাঁর বাবা ছেলেকে নিয়ে কলকাতার পথে রওনা হন। সঙ্গে সেই গুরুমশাইও ছিলেন। রাস্তার মাইলস্টোন দেখে বালক ছেলেটি সেদিন নিজেই ইংরেজি সব ডিজিট শিখে ফেলেন। উচ্ছ্বসিত গুরুমশাই তখন বিদ্যাসাগরের বাবাকে বলেছিলেন, ‘এই ছেলের লেখাপড়ার ব্যাপারে যত্ন নেবেন। যদি বেঁচে থাকে, মানুষ হতে পারবে।’
অন্যদিকে এডিসনকে তাঁর স্কুলটিচার ‘জড়বুদ্ধিসম্পন্ন’ বলেছিলেন। বারবার প্রশ্ন করার কারণে শিক্ষকেরা তাঁর ওপর বিরক্ত ছিলেন। স্কুল থেকে পাঠানো চিঠিতে লেখা ছিল: ‘আপনার সন্তান পুরোপুরি জড়বুদ্ধিসম্পন্ন। আমরা আর তাকে স্কুলে দেখতে চাই না।’ এডিসন তখনো পড়তে শেখেননি। তাই চিঠির কথাগুলো তাঁর জানা ছিল না। মা তাঁকে চিঠিটা পড়ে শুনিয়েছিলেন এভাবে: ‘আপনার ছেলে অতি মেধাবী। এই স্কুলে তাকে শেখানোর মতো শিক্ষক নেই। দয়া করে ছেলেকে আপনি নিজে শেখাবেন।’ এরপর এডিসন তাঁর মায়ের উদ্যোগে নিজেই লেখাপড়া শুরু করেন।
ব্যক্তির সফলতা
ওপরের দুটি উদাহরণ এই প্রশ্ন তোলে, ব্যক্তির সফলতার পেছনে কার ভূমিকা প্রধান? প্রতিষ্ঠানের, না ব্যক্তির নিজের? ব্যক্তির বিকাশ ও সফলতার পেছনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা কতটা? আর ব্যক্তির নিজের ভূমিকা কতটা? এসব নিয়ে তর্ক চলতে পারে। কেউ কেউ মনে করেন, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বাস্তবে পড়াশোনার আগ্রহ নষ্ট করে দেয়। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তির বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে, নষ্ট করে সৃজনীশক্তি। কারণ, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নির্দিষ্ট কাঠামোয় চলতে বাধ্য করে। অন্যদিকে ব্যক্তির নিজের আগ্রহের লেখাপড়া সফলতার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।
লেখাপড়া করে যে...
এরপরেও প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া জনপ্রিয় হয়েছে। এর পেছনে রাষ্ট্রের ভূমিকা আছে। তা ছাড়া আধুনিক যুগের শুরু থেকেই নগরকেন্দ্রিক অফিস ও কাজকর্ম বেড়েছে। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠাননির্ভর লেখাপড়ার ব্যাপারে মানুষের আগ্রহও বেড়েছে। মানুষ দেখেছে, লেখাপড়ার মাধ্যমে ভালো চাকরি ও আয়রোজগার করা যায়। ফলে দরিদ্র পরিবারগুলোও কষ্ট করে সন্তানকে লেখাপড়া করানোর চেষ্টা করেছে। তিন-চার দশক আগেও মানুষের মুখে মুখে ফিরত—‘লেখাপড়া করে যে, গাড়ি–ঘোড়া চড়ে সে।’
বেকারত্ব কেন
তবে এখন দেখা যায়, লেখাপড়া করলেই নিজের গাড়িতে চড়া যায় না। বরং চাকরির বাজারে সংকট তৈরি হয়েছে। নগরকেন্দ্রিক ‘ভদ্র’ জীবনের প্রতি অতি আগ্রহী হয়ে ওঠার কারণে এমনটি ঘটেছে। আসলে সমাজের নিজেরই কাজ উৎপাদনের একটা পদ্ধতি থাকতে হয়। আর রাষ্ট্রকে সেখানে সহায়তা করতে হয়। যেমন নগরে মানুষ বাড়তে থাকলে গাড়িও বাড়তে থাকে। তখন অধিকসংখ্যক চালক তৈরির জন্য রাষ্ট্রকে গাড়ি কেনার ঋণ সুবিধা দিতে হবে। কিন্তু সমাজের চাহিদার প্রতি রাষ্ট্রের দায়হীনতার কারণে বেকারত্ব বেড়েছে। লেখাপড়া কেন—এই প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে।
লেখাপড়া কী দেয়
প্রথম কথা, লেখাপড়া চাকরি বা কাজের সুযোগ তৈরি করে। পদ্ধতিগত শিক্ষা বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার তাই এত গ্রহণযোগ্যতা। দ্বিতীয়ত, ব্যক্তির নিজের উন্নয়নেও ভূমিকা রাখে লেখাপড়া। সে বুঝতে শেখে নিজের সক্ষমতা, কাজের পদ্ধতি। এ ছাড়া লেখাপড়ার মধ্য দিয়ে সামাজিক ও পেশাগত মর্যাদা বাড়ে, তৈরি হয় সূক্ষ্ম ও গভীর চিন্তার ক্ষমতা। এর বাইরেও লেখাপড়ার কিছু পরোক্ষ ভূমিকা আছে। যেমন লেখাপড়া মানুষকে সভ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে। একই সঙ্গে এর মধ্য দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্র এগিয়ে যায়।
সনদের গুরুত্ব
ব্যক্তি কতটুকু লেখাপড়া শিখল, তার পরিমাপক হয়ে দাঁড়ায় সনদ ও নম্বরপত্র। চাকরির আবেদন বা ভালো চাকরি পাওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে সনদ। দক্ষতা যাচাইয়ের ভালো কোনো পদ্ধতি না থাকায় পড়াশোনা হয়ে পড়েছে সনদনির্ভর। বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস ও নকল করার প্রধান কারণও এটি। অথচ পরীক্ষায় পাসের সঙ্গে কিংবা চাকরি পাওয়ার সঙ্গে জীবনের সফলতার সম্পর্ক খুব নিবিড় নয়। স্কুল পাস না করা কিংবা উচ্চতর পড়াশোনা শেষ করতে না পারা বহু সফল মানুষ আশপাশে দেখা যায়।
শিক্ষার উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি
শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে দুটি ভিন্নতর মত আছে। একদল মনে করে, শিক্ষার উদ্দেশ্য পরিবর্তিত সময়ের সঙ্গে মানিয়ে মানুষকে চলতে শেখানো। আরেক দল মনে করে, শিক্ষার উদ্দেশ্য মানুষের মনকে উদার ও বিস্তৃত করা। তবে উদ্দেশ্য যা–ই হোক, রাষ্ট্র নিজস্ব নীতি ও কৌশল নিয়ে শিক্ষাপদ্ধতি সাজায়। এ ক্ষেত্রে পেশাগত দক্ষতা বাড়ানোর জন্য পাঠ্যবইয়ে নতুন নতুন লেখা বা উপকরণ যোগ করা হয়। আবার চাহিদার দিকে লক্ষ রেখে উচ্চতর পর্যায়ে বিভাগ খোলা হয় কিংবা কোর্স যুক্ত করা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, পাঠ্যবই ও সহায়ক-বই জ্ঞান আহরণের কাজটি সহজ করে।
সফল হওয়ার উপায়
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও নিজের উদ্যোগে লেখাপড়া—দুই উপায়েই ব্যক্তিকে সফল হতে দেখা যায়। তাই রেজাল্টই চূড়ান্ত কথা নয়। ব্যক্তিকে হয়ে উঠতে হয় কৌতূহলী, অনুসন্ধিৎসু। খোঁজ করতে হয় নতুন নতুন উপায়ের। দেখতে শিখতে হয় বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। অর্জন করতে হয় কাজের উপযোগী দক্ষতা। সফল হওয়ার জন্য অন্যের কাছ থেকে পাওয়া অনুপ্রেরণা টনিকের মতো কাজ করে। বিদ্যাসাগর আর এডিসনই তার প্রমাণ। অবশ্য একজন সফল ব্যক্তি নিজেও নিজেকে নানাভাবে অনুপ্রেরণা দিতে থাকেন।