জলবায়ু পরিবর্তন ও খাদ্য সংকটে হুমকিতে সুন্দরবনের বাঘ

ফানাম নিউজ
  ৩০ জুলাই ২০২৫, ০৮:৪৫

বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে সুন্দরবনে। জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্য সংকট ও চোরাশিকারিদের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে বিপন্ন প্রাণী বাঘ। প্রাকৃতিক বাসস্থান সংকুচিত হওয়ার পাশাপাশি খাদ্যের ঘাটতি বাঘের অস্তিত্বকে মারাত্মকভাবে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। ফলে বাঘের টিকে থাকা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদদের মতে, বাঘের খাদ্য চাহিদার প্রায় ৭৮ শতাংশই পূরণ হয় হরিণ শিকার করে। অথচ সুন্দরবনে হরিণই নিরাপদ নয়। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বারবার জলোচ্ছ্বাস ও লবণাক্ততার মাত্রা বাড়ছে সুন্দরবনে। ফলে বনের পুকুর ও জলাশয়ে মিঠাপানির অভাব দেখা দিয়েছে। এতে খাদ্য শৃঙ্খলে ব্যাঘাত ঘটছে। প্রতিবেশব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল হরিণ, বন্য শূকর, বানরসহ অন্যান্য প্রাণী কমে যাচ্ছে।

সবশেষ গত রোববার (২৭ জুলাই) বিকেলে সুন্দরবনে ফাঁদে আটকে পড়া একটি হরিণ উদ্ধার এবং বিপুল পরিমাণ হরিণ শিকারের ফাঁদ জব্দ করেছে বন বিভাগ। সেদিন ফাঁদে আটকা পড়া হরিণ উদ্ধার করে এক কিলোমিটার দৈর্ঘের বেশি ফাঁদ পুড়িয়েছে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের বিশেষ সুরক্ষা ও সাড়া প্রদানকারী স্পার্ট টিম।

বন বিভাগের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সবশেষ গত তিন মাসে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগে প্রায় সাড়ে চার হাজার শিকারি ফাঁদ উদ্ধার করা হয়েছে। এমনকি এই সময়ে তিনটি হরিণ উদ্ধার করে বনের অন্যত্র ছাড়া হয়েছে।

সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, সুন্দরবনে প্রতিনিয়ত হরিণ শিকার হচ্ছে। বাঘ শিকারের চেষ্টাও হচ্ছে। আমরা দেখেছি, ফাঁদগুলোর মধ্যে কিছু ছিল বাঘ শিকারের জন্য। আমাদের টিম ঝুঁকি নিয়ে বনের ভেতরে হেঁটে হেঁটে এই ফাঁদগুলো উদ্ধার করছে। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।

রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, হরিণের প্রজনন ভালো। যদি তাদের নিরাপদ আবাসস্থল দেওয়া যায় তাহলে বাঘের খাদ্যের যোগানও হবে। প্রাণ-প্রকৃতিও টিকে থাকবে। কিন্তু আমাদের মানুষ তো ভালো না। মানুষ হরিণের মাংস খেতে চায় এবং চাহিদাও বেড়ে যাচ্ছে। আর চোরাশিকারিরা গোপনে ঢুকে এসব অপরাধ ঘটায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বনের ভেতর হরিণের সংখ্যাও কমছে, যা বাঘের খাদ্য সংকটকে তীব্র করে তুলছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এ আজিজ বলেন, বাঘ যত খাবার খায় তার সিংহভাগ চিত্রা হরিণ থেকে আসে। এই প্রাণী কমে গেলে সংকট আরও বাড়বে। ফলে হরিণ সংরক্ষণে জোর দিতে হবে।

এম এ আজিজ বলেন, আমাদের ২০২৩ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সুন্দরবনে চিত্রা হরিণের আনুমানিক সংখ্যা এক লাখ ৩৬ হাজার ৬০৪টি। বাঘের দ্বিতীয় প্রধান খাবার বন্য শূকরের আনুমানিক সংখ্যাও ৪৭ হাজার ৫১৫টি। তবে মানুষ নিয়মিত সেখান হরিণ শিকার করছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, যা সুন্দরবনের ভেতরে লবণাক্ততা বাড়িয়ে তুলছে। নদীর পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় মিষ্টি পানির ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। ফলে বনের অনেক অংশেই গাছপালা মরে যাচ্ছে। এতে কমছে হরিণ ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর সংখ্যা; যা বাঘের মূল খাদ্য।

অধ্যাপক এম এ আজিজ বলেন, উজানের পানি কমে যাচ্ছে। গঙ্গার পানি কমে যাওয়ায় সুন্দরবনে মিঠাপানির প্রবাহ দিন দিন কমছে। ফলে বনের বৈচিত্র্য কমছে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নেতিবাচক পরিবর্তন আসছে। বাঘের আবাসের বৈচিত্র্য আসছে। জলোচ্ছ্বাস বা ঘূর্ণিঝড় হলে বাঘ ও হরিণ অনেক হুমকির মুখে পড়ে। এজন্য বন বিভাগ উঁচু টিলা করেছে, পুকুর করেছে। কিন্তু সেগুলো প্রয়োজনের তুলনায় কতটা কার্যকর সেটা বলা কষ্টকর।

বন্যপ্রাণী রক্ষায় কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছে বন বিভাগ। বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সুন্দরবনের চাঁদপাই, শরণখোলা, খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জের প্রতিটিতে তিনটি করে মোট ১২টি বাঘের কিল্লা নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়াও সুন্দরবনের মধ্যে মিঠাপানির আধার হিসেবে ১১৫টি পুকুর আছে। এর মধ্যে বিভিন্ন প্রাণীর জন্য ছোট আকারের পুকুর ৩৫টি। আর মানুষ ও প্রাণী উভয়ের জন্য ৮০টি পুকুর আছে। তবে কয়েকটি পুকুর ঘূর্ণিঝড় রিমালের জলোচ্ছ্বাসে লোনাপানিতে তলিয়ে গেছে।

সুন্দরবন রক্ষা কমিটি সাতক্ষীরা অঞ্চলের সদস্য সচিব রাজিব হোসাইন বলেন, সুন্দরবনে সবচেয়ে বেশি হরিণ শিকার হয় বাগেরহাট রেঞ্জে। চোরাইচক্রের অধিকাংশই বরগুনার পাথরঘাটা এলাকার। এরা বড় বড় ফিশিং ট্রলার নিয়ে সমুদ্র পথে সুন্দরবনে প্রবেশ করে, যে পাশে বন বিভাগের টহল একেবারে নেই। এরা সুন্দরী গাছ কাটে। একটা না, দুইটা না, শত শত হরিণ জবাই করে গাছ আর হরিণ একসঙ্গে নিয়ে আসে। তারা ওই পাশ দিয়ে বেপরোয়াভাবে প্রবেশ করে, যেখানে কোনো কোস্ট গার্ড নেই।

রাজিব হোসাইন বলেন, সুন্দরবনের যেসব এলাকায় কেওড়ার ঘনত্ব বেশি, সেখানেই হরিণদের আনাগোনা বেশি। কারণ হরিণেরা কেওড়ার পাতা খেয়ে বাঁচে। শিকারিরা এই আচরণকে কাজে লাগিয়ে সেইসব এলাকায় ফাঁদ পেতে হরিণ ধরে ফেলছে। অন্যদিকে বানরগুলো হরিণকে পাতা ও ফল পেড়ে দেয়। বানরের সঙ্গে হরিণ সম্পর্কিত, হরিণের সঙ্গে বাঘ সম্পর্কিত।

‘সুন্দরবনে অন্যতম একটি সংকট হলো মাছ শিকারে বিষ প্রয়োগের প্রবণতা। অনেক জেলেই খালে বিষ প্রয়োগ করে মাছ ধরে, যা শুধু মাছ নয়, অন্য বন্যপ্রাণীকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বাঘের খাবার তালিকায় থাকা অনেক ছোট প্রাণী বিষক্রিয়ায় মারা যাচ্ছে বা দুর্বল হয়ে পড়ছে, যা পরোক্ষভাবে বাঘের খাদ্য সরবরাহকে প্রভাবিত করছে।’ যোগ করেন রাজীব হোসাইন।

বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজের (বারসিক) পরিচালক ও বন্যপ্রাণী গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, বাস্তুসংস্থান রক্ষা করা ছাড়া বাঘ সংরক্ষণ সম্ভব নয়। বাঘ, হরিণ, বানর কিংবা অন্যান্য প্রাণী একে অপরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। একটির ক্ষতি মানে অন্যটির জন্য বিপদ।

বর্তমানে বাঘের সংখ্যা ১২৫। বাস্তব সংখ্যা কিন্তু এটা না। তার কম কিংবা বেশি হতে পারে। তবে আমাদের প্রত্যাশা ছিল বাঘের সংখ্যা আরও বেশি হওয়া। কিন্তু সেটা হয়নি। -অধ্যাপক ড. এম. মনিরুল এইচ. খান

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান বিজ্ঞান চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক ড. এম. মনিরুল এইচ. খান বলেন, বর্তমানে বাঘের সংখ্যা ১২৫। বাস্তব সংখ্যা কিন্তু এটা না। তার কম কিংবা বেশি হতে পারে। তবে আমাদের প্রত্যাশা ছিল বাঘের সংখ্যা আরও বেশি হওয়া। কিন্তু সেটা হয়নি। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, নেপাল ও ভুটান বাঘ সংরক্ষণে যতটা এগিয়ে গেছে, তাদের তুলনায় আমরা অনেকটা পিছিয়ে আছি। ২০১০ সালে রাশিয়ায় বাঘ সম্মেলনে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণের একটা লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ বাঘের সংখ্যা দুই গুণ না করলেও অনেকটা কাছাকাছি গিয়েছে, কিন্তু আমরা সেটা পারিনি। আমাদের এই বৃদ্ধি নগণ্য। তবে সুন্দরবনের যে আয়তন এখানে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির একটা সুযোগ আছে।

এজন্য বাঘ ও হরিণ শিকার রোধ করা গেলে বাঘের সংখ্যা বাড়বে। বাঘও চোরাশিকার হয় কিন্তু সেসব খবর সব সময় মিডিয়ায় আসে না বলে জানান এই অধ্যাপক।

বন অধিদপ্তরের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ বলেন, ‘আমরা নিরাপত্তায় পেট্রলিং ও ফাঁদ উদ্ধার করে থাকি। এছাড়া জলোচ্ছ্বাসের সময় উঁচু টিলা ও পুকুর নির্মাণ করা হয়। যারা চোরাইশিকার করে এর পেছনে কারো না কারো হাত রয়েছে। তবে আমরা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছি এগুলো প্রতিরোধ করতে। আমাদের টিম কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের একটি বাঘ সংরক্ষণ প্রজেক্ট আছে। এর আওতায় বাঘ ও হরিণ শিকারের যেসব অপরাধপ্রবণ এলাকা রয়েছে, সেসব জায়গায় ক্যামেরা ও ড্রোনের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করে থাকি।’

তিনি বলেন, ‘কিছু অপরাধপ্রবণ এলাকা আছে, সেগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলোতে প্রজেক্টের মাধ্যমে আমরা ক্যামেরা ট্র‍্যাপিং করব।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়