এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বর্তমান পুষ্টি পরিস্থিতি সঙিন। এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের প্রায় ৪০ শতাংশ স্বাস্থ্যকর খাদ্য পাচ্ছে না। কিছু এলাকায় ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াই অগ্রগতির পরিবর্তে উল্টো অবনতি হয়েছে। দারিদ্র্য (এসডিজি–১) এবং ক্ষুধা (এসডিজি–২) উভয়কে পরাস্ত করার জন্য টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) পূরণের দিকে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, কোভিড-১৯ মহামারি তার অগ্রগতিকে থামিয়ে দিয়েছে। এটি জীবন ও জীবিকা উভয়কেই ধ্বংস করেছে।
সৌভাগ্যের বিষয়, গোটা ছবিটি সম্পূর্ণ অন্ধকারে নয় এবং ইতিমধ্যে আশাবাদ ও গতিশীলতার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এ অঞ্চলের কৃষি, খাদ্যব্যবস্থার অগ্রগতিগুলো এখানকার খাদ্য টেকসইভাবে উৎপাদন, বিপণন এবং খাদ্য গ্রহণের পন্থাগুলোতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনছে। এ রূপান্তর এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের উত্পাদকদের অধিকতর সচেতনতা এবং ভোক্তাদের পুষ্টিকর খাবারের ক্রমবর্ধমান চাহিদাকে প্রতিফলিত করছে।
শস্য উৎপাদন ও গবাদিপশু পালনকারী কৃষক, মৎস্যজীবী, অন্যান্য উৎপাদক এবং ছোট-বড় খুচরা বিক্রেতা—সবাই সফলভাবে উদ্ভাবনী ধারণা এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকছেন। উৎপাদন এবং টেকসই সম্পদ ব্যবস্থাপনা ক্ষেত্রে অর্জিত এ উন্নতিগুলো তাদের পকেটে আরও অর্থ জমা করতে পারছে। এর পাশাপাশি পরিবেশগত অবক্ষয় ঠেকানোর ক্ষেত্রেও তা সহায়তা করছে।
এসব একটি গভীর ইতিবাচক পরিবর্তনের ধারা সৃষ্টি করতে সাহায্য করছে, যা বিশ্বের অন্যান্য অংশেও প্রভাব ফেলছে। এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সমগ্র কৃষি খাদ্য শৃঙ্খলে উদ্ভাবন এবং ডিজিটালাইজেশনের একটি ক্রমবর্ধমান আন্দোলন স্পষ্ট রূপ নিয়েছে। খুচরা মুদি মাল এবং খাদ্য কেনাকাটা ব্যবস্থা এ ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। শুধু উন্নত অর্থনীতির দেশ নয়, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে খাদ্য ও মুদি মালের পাঁচটির মধ্যে চারটিই অনলাইনে বিক্রয় হয়ে থাকে। এটি কৃষি, খাদ্যব্যবস্থার উত্তরণের একটি দিক, যা পশ্চিম এশিয়া, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পূর্ব এশিয়া থেকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপের দেশগুলো পর্যন্ত—তথা গোটা এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোকে দ্রুত পরিবর্তন করে ফেলছে।
প্রশান্ত মহাসাগরীয় ক্ষুদ্র দ্বীপভিত্তিক উন্নয়নশীল দেশগুলোতে (স্মল আইল্যান্ড ডেভেলপিং স্টেটস, সংক্ষেপে সিডস্) তৃণমূল পর্যায়ের উদ্যোক্তারা ক্রমে এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের উদ্ভাবনী স্মার্টফোন অ্যাপগুলো উৎপাদক এবং ভোক্তাদের খাদ্য সম্পর্কে তথ্য দিয়ে সচেতন করতে ও পুষ্টিকর খাদ্য পছন্দ করতে সাহায্য করছে। বেসরকারি এবং উন্নয়ন খাতগুলোও ক্রমবর্ধমানভাবে প্রাপ্ত ও সংরক্ষিত উপাত্ত ব্যবহার করছে, যাতে বাজারে কৃষিপণ্যের সরবরাহ শৃঙ্খলাকে আরও দক্ষ এবং সময়োপযোগী করে তোলা যায় এবং চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোর একটি মানচিত্র তৈরি করা যায়৷ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং ফিজি সরকারের যৌথ উদ্যোগে ২০২১ সালের আগস্টে ‘সিডস সলিউশন ফোরাম’–এর দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে এ ধরনের বেশ কিছু উদ্ভাবন প্রদর্শিত হয়েছিল।
চাহিদা অনুযায়ী এবং কোনো বাধা ছাড়াই নিরবচ্ছিন্ন উপাত্তপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে এখনো কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। যেমনটি আমরা দেখেছি ওশেনিয়া অঞ্চলের দেশ টোঙ্গাতে। ওই অঞ্চলের হাঙ্গা টোঙ্গা-হাঙ্গা হা’পাই আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের সময় টোঙ্গার সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে যাওয়া ইন্টারনেট যোগাযোগের তার বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। এতে সেখানে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য এ বিপত্তিগুলোই আসন্ন অনেক বাধাবিপত্তি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় নতুন ধারণা নিয়ে আসবে। কৃষি খাদ্যব্যবস্থাকে আরও দক্ষ, অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্থিতিস্থাপক এবং সবার জন্য টেকসই উপকারী অবস্থায় রূপান্তর করতে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) তার সদস্যদের সঙ্গে এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলজুড়ে কাজ করছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য তথ্য, প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনকে আরও গতিশীল করতে আমরা সদস্যদেশগুলোর নীতিনির্ধারকদের পরিকল্পনায় প্রণয়নে সহায়তা করছি।
এফএওর ডিজিটাল ভিলেজেস ইনিশিয়েটিভ শীর্ষক এক হাজার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগের অংশ হিসেবে আমরা সক্রিয়ভাবে এ অঞ্চলজুড়ে ডিজিটাল গ্রামগুলোকে চিহ্নিত করছি এবং সেগুলোকে সহায়তা দিচ্ছি। আমরা বিভিন্ন দেশের নেতৃত্বাধীন ‘সিডস সমাধান’ এবং ‘হ্যান্ড-ইন-হ্যান্ড অংশীদারত্ব’কে লালন করছি ও তাদের কার্যক্রমের প্রচার চালিয়ে যাচ্ছি। এসব কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত পরিবেশবিনাশী ঘটনা প্রশমন ও অভিযোজনের পরামর্শ দেওয়া এবং মহামারি ও জলবায়ু সংকটের কারণে জীবন ও জীবিকার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করা।
৮ থেকে ১১ মার্চ ঢাকায় এফএও আয়োজিত এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক সম্মেলনের ৩৬তম অধিবেশনে এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে। এ অঞ্চলের এফএও সদস্য ৪৬। এসব দেশের প্রতিনিধিরা জাতিসংঘের খাদ্যব্যবস্থা সম্মেলন ২০২১–এর সুপারিশগুলোর সঙ্গে এফএও কৌশলগত কাঠামো ২০২২-৩১–এর অধীনে রূপান্তরমূলক অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্য একত্র হবে। এফএও সম্মেলনের ফলোআপের জন্য সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত সমন্বয় কেন্দ্রের আয়োজনে নেতৃত্ব দিচ্ছে, যা জাতীয় অগ্রাধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থার রূপান্তরের দিকে জাতীয় পথরেখার অধিকতর উন্নয়ন ও তা বাস্তবায়নে দেশগুলোকে সহায়তা করবে।
বিশ্ব পরিস্থিতিকে আবার ভালোভাবে এগিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে আমরা এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আমাদের সদস্যদের সঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে আমরা নারী ও যুবশ্রেণিকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করা গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সুশীল সমাজ সংস্থা, সমবায় প্রতিষ্ঠান, সংসদ সদস্যরা এবং বেসরকারি খাতের সঙ্গে অধিকতর অংশীদারত্ব তৈরি করব।
এফএও এই অঞ্চলকে বড় চিন্তা করতে এবং দৃঢ়ভাবে কাজ করতে সহায়তা করছে। আমরা একটি গঠনমূলক হাত বাড়িয়ে দিয়েছি, কিন্তু আমাদের সম্মিলিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে আমাদের আরও অনেক বাড়িয়ে দেওয়া হাতের প্রয়োজন। আমাদের শিশুদের জন্য একটি ভালো ভবিষ্যৎসহ একটি অধিকতর উন্নত বিশ্বের জন্য আমাদের আরও ভালো উৎপাদন, আরও ভালো পুষ্টি, একটি ভালো পরিবেশ এবং কাউকে পেছনে না রেখে সবার জন্য একটি ভালো জীবন দরকার। এর জন্য দরকার দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং দক্ষ, কার্যকর ও সুসংগত বহুপক্ষীয় পদক্ষেপ।
লেখক: কু ডংগিউ, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মহাপরিচালক
সূত্র: প্রথম আলো