বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ‘শিগগির দেশে ফিরবেন’, ‘আগামী মাসে ফিরবেন’, ‘এ বছরের মধ্যে ফিরবেন’, ‘নতুন বছরের শুরুতে ফিরবেন’- এমন আলোচনা সেই ৫ আগস্টের পর থেকেই। দলের সব পর্যায়ের নেতাদের মুখে এখনো শোনা যাচ্ছে এমন আশার বাণী। যদিও লন্ডনে অবস্থান করা তারেক রহমান এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত নিজে কোনো কথা বলেননি।
নেতারা গণমাধ্যমে বক্তব্য দিলেও ঠিক কবে নাগাদ তারেক রহমান দেশে ফিরবেন- সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য কারও কাছেই নেই। তার নামে থাকা সব মামলার নিষ্পত্তি এখনো হয়নি। আইনজীবীরা বলছেন, আইনি প্রক্রিয়া মেনে সব মামলার নিষ্পত্তি হবে। আর নিষ্পত্তি না হলেও তারেক রহমান চাইলে যে কোনো সময় দেশে আসতে পারেন।
তবে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রের অনুমান, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে তারেক রহমান বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখবেন।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলের পাশাপাশি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে ভার্চুয়ালি সরাসরি যুক্ত থেকে বক্তব্য রাখলেও দেশে ফেরা নিয়ে এখনো তিনি নিজে কিছু বলেননি। বিভিন্ন মহলে গুঞ্জন, তারেক রহমানের দেশে ফেরার জন্য কূটনৈতিক চূড়ান্ত সবুজ সংকেতের অপেক্ষায় আছেন। আবার বলা হচ্ছে, বিদেশে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার চিকিৎসা শেষে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে একসঙ্গে মা-ছেলে দেশে ফিরবেন।
মামলার সঙ্গে তারেক রহমানের দেশে ফেরার কোনো সম্পর্ক নেই। তারেক রহমান গত ১৬-১৭ বছর দেশের বাইরে আছেন। কোটি কোটি নেতাকর্মী অপেক্ষা করছেন। মানুষের প্রত্যাশার প্রতি সম্মান এবং নেতাকর্মীদের আবেগকে ধারণ করে দেশে আসার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন।- ব্যারিস্টার কায়সার কামাল
একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ের পর গত ১ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত একটি কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আমাদের মধ্যে সহিসালামতে ফিরে আসবেন খুব তাড়াতাড়ি।
সম্প্রতি লন্ডনে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দল যখন মনে করবে, তখন তারেক রহমান দেশে ফিরবেন। এছাড়া তার আরও কিছু আইনি জটিলতা রয়েছে, সেগুলো শেষ করে দেশে যাবেন।
জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি এবং বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিন ও দলটির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল মনে করেন, মামলার সঙ্গে তারেক রহমানের দেশে ফেরার কোনো সম্পর্ক নেই। মামলা আইনের গতিতে চলবে।
অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিন বলেন, ‘তারেক রহমানের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে উনি কবে দেশে ফিরবেন।’
ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, ‘মামলার সঙ্গে তারেক রহমানের দেশে ফেরার কোনো সম্পর্ক নেই। তারেক রহমান গত ১৬-১৭ বছর দেশের বাইরে আছেন। কোটি কোটি নেতাকর্মী অপেক্ষা করছেন। মানুষের প্রত্যাশার প্রতি সম্মান এবং নেতাকর্মীদের আবেগকে ধারণ করে দেশে আসার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন।’
তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে জাতীয়তাবাদী যুবদলের নেতাকর্মীদের কাছে কী তথ্য আছে জানতে চাইলে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়ন বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই।’
জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহসান বলেন, ‘সঠিক কোনো তথ্য নেই। আশা করছি নতুন বছরে তারেক রহমান বাংলাদেশে পা রাখবেন।’
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেন, ‘দ্রুত তারেক রহমান দেশে ফিরবেন।’
জাতীয়তাবাদী যুবদলের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়ন বলেন, ‘তারেক রহমানের নামে মামলা রয়েছে, ওনার যখন ইচ্ছা হবে তখন আসবেন।’
জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহসান বলেন, ‘তারেক রহমানের নামে অসংখ্য মামলা রয়েছে যেগুলো মিথ্যা, বানোয়াট। সেই মামলাগুলোর প্রসেসিং চলছে। আশা করি সংশ্লিষ্ট সবাই সহযোগিতা করবে।’
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেন, ‘তারেক রহমান আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তার মামলাগুলো পর্যবেক্ষণ করছেন। সবমিলিয়ে তিনি দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেবেন। আমরা চাই সরকার এই ডিসেম্বরের মধ্যেই তার নামে দায়ের হওয়া মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করে নেবে।’
তারেক রহমানের নামে কত মামলা?
বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল জানান, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে গত ওয়ান ইলেভেন সরকারের সময় ২১টি মামলা ছিল। এরপর শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা, অর্থপাচার মামলা হলো। পরবর্তীসময়ে ২০১৪-১৫ সালের দিকে তারেক রহমান লন্ডনে একটা বক্তব্য দিয়েছিলেন, সেই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের প্রায় ৬৪ জেলায় ছাত্রলীগ, যুবলীগ বা অনেক আইনজীবী মানহানির মামলা করেছিলেন। সবমিলিয়ে ৮৫টির মতো মামলা রয়েছে।
মামলা নিষ্পত্তির বিষয়ে দল থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, আমরা আইনজীবীরা উদ্যোগ নিয়েছি। আইনজীবী হিসেবে সর্বদা চেষ্টা করছি আইনি প্রক্রিয়ায় মামলাগুলো নিষ্পত্তির। কিন্তু সরকারের নির্বাহী ক্ষমতায় অনেক কিছু করতে পারে। রাজনৈতিক মামলাগুলো ৪০১ ধারা অনুযায়ী শর্তমুক্ত বা শর্তযুক্তভাবে সরকার স্থগিত করতে পারে।–অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিন
তিনি বলেন, ‘ওয়ান ইলেভেনের সময়ে দায়ের হওয়া অনেকগুলো মামলা উচ্চ আদালতে বাতিল করা হয়েছে। মানহানিরও অনেকগুলো মামলা খারিজ হয়ে গেছে। আইনি প্রক্রিয়ায় সবগুলো মামলা বাতিল হয়েছে। যে সব মামলায় তিনি চার্জশিটভুক্ত ছিলেন না, এফআইআরেও নাম ছিল না সে সব মামলায় আমরা আদালতে গিয়েছি আদালত বাতিল করে দিয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘এ বি সিদ্দিক নামে একজন মামলা করেছেন উনি জীবিত নেই। এ ধরনের মামলা খারিজ হয়েছে। মানহানি তো তার হয়েছিল যিনি মামলা দায়ের করেছিলেন। অনেক আওয়ামী লীগ বা যুবলীগ, ছাত্রলীগ নেতারা মামলা করে পরে খোঁজ-খবর নেয়নি। দেখা গেলো ২০১৪ সালের মামলা দায়ের করেছে এখন ২০২৪ সাল, ১০ বছরে ওনাদের পক্ষ থেকে কোনো সাক্ষ্য উপস্থাপন করেননি।
তারেক রহমানের মামলা প্রত্যাহারের জটিলতা কী?
কায়সার কামাল বলেন, ‘বাংলাদেশে ১৬ বছর কার্যত আইনের শাসন ছিল না, শেখ হাসিনার শাসন ছিল। তার আন্ডারে বাংলাদেশ ছিল। তার কথা বা তাকে খুশি করতে বিচার বিভাগ অনেক কাজ করেছে। ৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে এই মামলার যিনি বাদী ছিলেন তিনি আদালতে এসে বলেছেন যে মামলাটা আমার ভুল হয়েছিল, আমি প্রত্যাহার করে নিতে চাই তিনি মামলা প্রত্যাহার করে নিলেন। মানহানির মামলাগুলো এর মধ্যে সরকার প্রত্যাহার করে নিতে পারে।’
কায়সার কামাল জানান, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় ১০ বছরের সাজা হয়েছে, যা পেন্ডিং রয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় সাজা হয়েছে। ওয়ান ইলেভেন সরকারের সময় এ মামলা হয়। অর্থপাচার মামলায় নিম্ন আদালত খালাস দিয়েছিলেন, সেই মামলা উচ্চ আদালতে এসে ৭ বছরের সাজা হয়েছে। নড়াইলে একটি মানহানি মামলায় দুই বছরের সাজা হয়েছিল এবং একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন।
তারেক রহমান কি আসলেই ‘শিগগির’ দেশে ফিরছেন?
কায়সার কামাল আরও বলেন, ‘দেখছি সরকার প্রেসনোট ইস্যু করেছে মামলা প্রত্যাহার করবেন। কিন্তু তারেক রহমানের সুস্পষ্ট নির্দেশনা, আমাদের যদি মামলা প্রত্যাহার করতে হয় তিনি যেন বাংলাদেশের সবশেষ ব্যক্তি হন অর্থাৎ, দেশের সমস্ত রাজনৈতিক দলের সমস্ত রাজনৈতিক নেতাকর্মী-সমর্থকদের মামলা প্রত্যাহারের পর যেন তার মামলা প্রত্যাহার করা হয়। সেটা ওনার উদারতা, নেতাকর্মীদের প্রতি ভালোবাসা।’
জয়নুল আবেদিন বলেন, ‘মামলা নিষ্পত্তির বিষয়ে দল থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, আমরা আইনজীবীরা উদ্যোগ নিয়েছি। আইনজীবী হিসেবে সর্বদা চেষ্টা করছি আইনি প্রক্রিয়ায় মামলাগুলো নিষ্পত্তির। কিন্তু সরকারের নির্বাহী ক্ষমতায় অনেক কিছু করতে পারে। রাজনৈতিক মামলাগুলো ৪০১ ধারা অনুযায়ী শর্তমুক্ত বা শর্তযুক্তভাবে সরকার স্থগিত করতে পারে।’
কায়সার কামাল বলেন, ‘৮৫টি মামলার অন্তত ৪০টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। আদালতের স্বীয় পর্যবেক্ষণ অনুসারে মামলাগুলোর নিষ্পত্তি হবে। এ ধরনের মামলায় বেশি সময় লাগে না আবার কম সময়ও লাগে না। এটা অগ্রিম বলা যায় না।’